১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান
গঠিত হয়, কিন্তু
পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত)
ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল প্রচুর। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা
দানের দাবী আদায়ের জন্যে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদগঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিশের
অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এ
কমিটির আহবায়ক ছিলেন।
উৎসঃ "Language Movement" (PHP)। Banglapedia - The National
Encyclopedia of Bangladesh। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত 2007-02-06। এবং Ekusher Shongkolon '80. Dhaka: Bangla Academy. 1980. পৃ: 102–103.
ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহদেখান যে উর্দু
পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেরই মাতৃভাষা নয়, এবং বলেন, "যদি আমাদের একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা
নির্বাচন করতে হয়, কেবলমাত্র
তখনই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনের ব্যাপারটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
(Source:
The Azad। 29 July 1947)
কিন্তু ১৯৪৮
সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের
একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব
পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ (যারা সংখ্যার বিচারে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ
ছিল) এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়। ফলে
পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবীতে শুরু হয় আন্দোলন। চলমান এই
গণআন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯
মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় পৌঁছান। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক
নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন, "উর্দু হবেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা”। ২৪ মার্চ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে তিনি একই
ধরনের বক্তব্য রাখেন। সভাতেই উপস্থিত শ্রোতাদের একটি বড় অংশ চিৎকার করে তার এই বক্তব্যের
প্রতিবাদ জানায়।
"Language Movement" (PHP)। Banglapedia - The National
Encyclopedia of Bangladesh। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত 2007-02-06।
পরবর্তীতে জিন্নাহর
উত্তরসূরি নতুন গভর্ণর জেনারেল খাজা নিজামুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারির এক
ভাষণে পুনরায় ঘোষণা করেন "উর্দু হবেই
পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা”। ৩১ জানুয়ারি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে মাওলানা ভাসানীর উপস্থিতিতে একটি
সভায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদ ২১ তারিখে সর্বময় প্রতিবাদের অংশ হিসেবে হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের
শিক্ষার্থীরা ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হয় এবং সরকারকে আরবি
লিপিতে বাংলা লেখার হাস্যকর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে বাংলাকে উপযুক্ত মর্যাদা
দানের দাবী জানায়। যখন ঢাকায় আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে তখন
২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ঢাকা শহরে ১৪৪
ধারা জারি করে। ঐদিন রাতে বৈঠক করে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১ তারিখ সকাল নয়টায় ছাত্ররা ছাত্ররা ঢাকা ১৪৪ ধারা
ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে শুরু করে। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটের কাছে একত্রিত হয়ে
প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিস কাঁদানে
গ্যাস বর্ষণ করে
ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।[৮] ছাত্রদের একটি
দল দৌড়ে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আশ্রয় নেয়, বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করতে থাকে। মিছিলটি ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে
পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক[১], সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে।
উৎসঃ দৈনিক আজাদ। 22 February 1952।
২২শে
ফেব্রুয়ারি পুরো প্রদেশজুড়ে মানুষ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশাল সব মিছিল বের করতে
শুরু করে এবং পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা জানায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা শহীদ
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ
শুরু করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে এর কাজ শেষ হয়। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ স্থাপত্যটি গুঁড়িয়ে দেয়।
১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনঃ
আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪
ডিসেম্বর তারিখে কৃষক শ্রমিক
পার্টি, পাকিস্তান
গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান
খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্টের প্রধার তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ঐ ইশতেহারের মধ্যে
প্রধান দাবি ছিল
Ø
২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতিরক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনঃ
১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত
অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফল নিচে তুলে ধরা
হলোঃ
দলের নাম
|
মোট আসন প্রাপ্তি
|
যুক্তফ্রন্ট
|
২২৩টি
|
কংগ্রেস
|
২৪টি
|
কমিউনিস্ট পার্টি
|
৪ টি
|
মুসলিম লীগ
|
০৯ টি
|
যুক্তফ্রন্ট সরকার:
১৯৫৪
সালের ৩ রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট যুক্তফ্রন্ট
মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় ১৫ই মে তারিখে। প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।
১৯৫৪ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্ণর
জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে দিয়ে শাসনতন্ত্রের
৯২ (ক) ধারা জারীর মাধ্যমে প্রদেশে গভর্ণরের শাসন প্রবর্তন করেন। (Source:
Wikipedia)
নানারকম টালবাহানা
করে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে
পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেন এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পাকিস্তানে তার
স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু থাকে। ১৯৬০ সালে আওয়ামী লীগের উত্থান হয়।
বিভেদ,
বৈষম্য,
শোষণ আর ষড়যন্ত্রঃ
পূর্ব আর পশ্চিম
পাকিস্তানের মাঝে শুধু যে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্ব তা নয়,
মানুষগুলোর ভেতরেও ছিল বিশাল দূরত্ব। তাদের চেহারা,
ভাষা, খাবার, পোশাক,
সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছু ছিল ভিন্ন, শুধু একটি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলোর মাঝে মিল ছিল-
সেটি হচ্ছে ধর্ম। এরকম বিচিত্র একটি দেশ হলে সেটি টিকিয়ে রাখার জন্যে আলাদাভাবে একটু বেশি
চেষ্টা করার কথা, কিন্তু
পাকিস্তানের শাসকেরা সেই চেষ্টা করল না। দেশভাগের সময় পশ্চিম
পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি, পূর্ব পাকিস্তানের ছিল চার কোটি, কাজেই সহজ হিসেবে বলা যায় শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা সবকিছুতেই যদি একজন পশ্চিম পাকিস্তানের লোক থাকে,
তাহলে সেখানে দুইজন পূর্ব পাকিস্তানের লোক থাকা উচিত। বাস্তবে হলো ঠিক
তার উল্টা, সবকিছুতেই
পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ ছিল শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। বাজেটের ৭৫% ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, ২৫% ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে, যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় ছিল বেশি, শতকরা ৬২ ভাগ। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি।
১৯৬৬
সালের ৬ দফাঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্যে স্বায়ত্বশাসন দাবি করে ১৯৬৬ সালে ৬
দফা ঘোষণা করলেন। ছয় দফাকে বিবেচনা করা
হতো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সবকরম অর্থনৈতিক শোষণ,
বঞ্চনা আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির এক অসাধারণ দলিল।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাঃ
৬ দফা দাবি পেশ করায় শেখ মুজিবের নামে মিথ্যা
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে জেলে দেওয়া হলো। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা কিছুতেই এটা মেনে নিল না এবং সারাদেশে আন্দোলন
শুরু হয়ে গেল। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল
ছাত্ররা, তাদের ছিল এগারো
দফা দাবি। মাওলানা আবদুল হামিদ খান
ভাসানী ছিলেন জেলের বাইরে, তিনিও এগিয়ে
এলেন। দেখতে দেখতে সেই
আন্দোলন একটি গণবিস্ফোরণে রূপ নিল।
১৯৬৯
সালের গণ অভ্যুত্থানঃ
৬৯-এর গণআন্দোলন রূপ নেয় গণ অভ্যুত্থানে। এই গণ অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছিল ফুটফুটে কিশোর মতিউর, প্রাণ দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ যার নামে আইয়ুব গেটের নাম
হয়েছিল আসাদ গেট। পাকিস্তান সরকার শেষ
পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সহ সব নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো।
১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ঃ
১৯৭০ সালের ১২ই
নভেম্বর ভোলার সাইক্লোন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের
সৃষ্টি করে, সেই সাথে জোয়ারের কারণে প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক
বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়া খান স্বীকার করে সরকার দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণেই
ত্রাণকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি
পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ
হয়ে ওঠে। ২৪শে নভেম্বর এক
সভায় মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের
প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন এবং অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনঃ
১৯৭০ সালের ৭
ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া
খান ক্ষমতায় এসেই পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেবার কথা ঘোষণা করে। উক্ত
নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় আওয়ামী লীগ পূর্ব
পাকিস্তানের ১৬২ আসনের ভেতরে ১৬০টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা
অর্জন করেছে। এই নির্বাচনের সম্পূর্ণ ফলাফল নিচে তুলে ধরা হলোঃ
দল
|
প্রাপ্ত ভোট (%)
|
মোট আসন
|
৩৮.৩%
|
১৬০
|
|
১৯.৫%
|
৮১
|
|
৪.৫%
|
৯
|
|
৩.৩%
|
৭
|
|
৪.০%
|
৭
|
|
৪.০%
|
৭
|
|
২.৩%
|
৬
|
|
৬.০%
|
৪
|
|
৬.০%
|
২
|
|
২.৯%
|
১
|
|
স্বতন্ত্র
|
৭.১%
|
১৬
|
মোট
|
১০০%
|
৩০০
|
প্রদেশওয়ারী ফলাফল:
পার্টি
|
পাঞ্জাব
|
সিন্ধু
|
NWFP
|
বেলুচিস্তান
|
পশ্চিম পাকিস্তান (মোট)
|
পূর্ব পাকিস্তান
|
আওয়ামী লীগ
|
০ (০.০৭%)
|
০ (০.০৭%)
|
০ (০.২%)
|
০ (১.০%)
|
০
|
১৬০ (৭৪.৯%)
|
পাকিস্তান পিপলস
পার্টি
|
৬২(৪১.৬%)
|
১৮(৪৪.৯%)
|
১(১৪.২%)
|
০ (২.৩%)
|
৮১
|
০
|
প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফলঃ
দল
|
পাঞ্জাব
|
সিন্ধু
|
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ
|
বেলুচিস্তান
|
পশ্চিম পাকিস্তান
|
পূর্ব পাকিস্তান
|
মোট
|
আওয়ামী লীগ
|
০
|
০
|
০
|
০
|
০
|
২৮৮
|
২৮৮
|
পাকিস্তান পিপলস
পার্টি
|
১১৩
|
২৮
|
৩
|
০
|
১৪৪
|
০
|
১৪৪
|
পিএমএল (কাইয়ুম)
|
৬
|
৫
|
১০
|
৩
|
২৪
|
০
|
২৪
|
পিএমএল (কনভেনশন)
|
১৫
|
৪
|
১
|
০
|
২১
|
১
|
২
|
জমিয়ত
উলেমা-ই-ইসলামী
|
২
|
০
|
৪
|
২
|
৮
|
০
|
৮
|
(Source G.W.Choudhury (1974) The last
days of United Pakistan p128-129)
অর্থাৎ প্রাদেশিক ফলাফলেও আওয়ামী লীগ
সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এই প্রথম
পাকিস্তান শাসন করবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার করে বলে
দিলেন, তিনি ছয় দফার কথা বলে জনগণের
ভোট পেয়েছেন এবং তিনি শাসনতন্ত্র রচনা করবেন ছয় দফার ভিত্তিতে,
দেশ শাসিত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে। পাকিস্তানের
সেনাবাহিনী তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, কোনোভাবেই বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেয়া যাবে না।
ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ষড়যন্ত্রঃ
জেনারেলদের ষড়যন্ত্রে
সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ছিল সেনাশাসক আইয়ুব খানের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী,
পশ্চিম পাকিস্তানের পিপল্স পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী
ভুট্টো। হঠাৎ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লারকানায় ‘পাখি শিকার’ করতে আমন্ত্রণ
জানাল। ‘পাখি শিকার’ করতে জেনারেল
ইয়াহিয়া খানের সাথে যোগ দিল পাকিস্তানের বাঘা বাঘা জেনারেল। বাঙালিদের হাতে কেমন করে
ক্ষমতা না দেয়া যায় সেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা সম্ভবত সেখানেই তৈরি হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে
ষড়যন্ত্র চলতে থাকলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেটি বাইরে বোঝাতে চাইল না।
তাই সে ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি
ঘোষণা করল ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। সবাই তখন গভীর আগ্রহে সেই
দিনটির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঠিক দুই দিন আগে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল।এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের
বুকের ভেতর
জমে থাকা ক্ষোভ সারা দেশে
বিস্ফোরণে রূপ নিলো।
উত্তাল মার্চঃ
জাতীয় পরিষদের
অধিবেশন স্থগিত হয়ে গেছে, এ ঘোষণাটি যখন
রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে, তখন ঢাকা
স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছে। মুহূর্তের মাঝে জনতা বিক্ষুদ্ধ
হয়ে ওঠে, ঢাকা স্টেডিয়াম
হয়ে ওঠে একটি যুদ্ধক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে আসে, পুরো ঢাকা শহর দেখতে দেখতে একটি মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। মানুষের মুখে তখন উচ্চারিত
হতে থাকে স্বাধীনতার স্লোগান:
‘জয় বাংলা’ ‘বীর বাঙালী
অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ
স্বাধীন কর।’
বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং সারাদেশে মিলিয়ে ৫ দিনের জন্যে হরতাল ও অনিদিষ্টকালের জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারকে কোনোভাবে সাহায্য না করার কথা বলেছিলেন এবং তাঁর মুখের একটি কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্যে কারফিউ দেয়া হলো ছাত্র জনতা সেই কারফিউ ভেঙে পথে নেমে এল। চারিদিকে মিছিল, স্লোগান আর বিক্ষোভ, সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরেও কেউ থেমে রইল না, দলে দলে সবাই পথে নেমে এল।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং সারাদেশে মিলিয়ে ৫ দিনের জন্যে হরতাল ও অনিদিষ্টকালের জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারকে কোনোভাবে সাহায্য না করার কথা বলেছিলেন এবং তাঁর মুখের একটি কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্যে কারফিউ দেয়া হলো ছাত্র জনতা সেই কারফিউ ভেঙে পথে নেমে এল। চারিদিকে মিছিল, স্লোগান আর বিক্ষোভ, সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরেও কেউ থেমে রইল না, দলে দলে সবাই পথে নেমে এল।
২ মার্চ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা
তোলা হলো। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ‘আমার সোনার
বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হলো।
পাঁচদিন হরতালের পর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে এলেন। ততদিনে পুরো পূর্ব পাকিস্তান চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর ভাষণ শুনতে এসেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আক্ষরিক অর্থে একটি জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ভাষণ খুব বেশি দেয়া হয়নি। এই ভাষণটি সেদিন দেশের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অকাতরে প্রাণ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জুগিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে একদিকে যখন সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে অন্যদিকে প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে পাকিস্তান মিলিটারির গুলিতে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। পাকিস্তান মিলিটারির গতিবিধি থামানোর জন্যে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পথে পথে ব্যারিকেড গড়ে তুলছে। সারাদেশে ঘরে ঘরে কালো পতাকার সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। দেশের ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। মাওলানা ভাসানী ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে বলে দিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেন আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে। ঠিক এই সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণহত্যার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠাল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বিচারপতি তাকে গভর্নর হিসেবে শপথ করাতে রাজি হলেন না। ইয়াহিয়া খান নিজে মার্চের ১৫ তারিখ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে, এর মাঝে প্রত্যেক দিন বিমানে করে ঢাকায় সৈন্য আনা হতে থাকে। যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে, কিন্তু জনগণের বাধার কারণে সেই অস্ত্র তারা নামাতে পারছিল না। ২১ মার্চ এই ষড়যন্ত্রে ভুট্টো যোগ দিল, সদলবলে ঢাকা পৌঁছে সে আলোচনার ভান করতে থাকে। এদিকে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে বসে। তাদের থামানোর জন্যে ঢাকা থেকে যে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় তাদের সাথে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস, কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট আর গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া সারা বাংলাদেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া গেল না। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসাতেও সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো।
পরদিন ২৪ মার্চ, সারাদেশে একটি থমথমে পরিবেশ মনে হয় এই দেশের মাটি, আকাশ, বাতাস আগেই গণহত্যার খবরটি জেনে গিয়ে গভীর আশষ্কায় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে ছিল।
গণহত্যার শুরু : অপারেশন সার্চলাইট
গণহত্যার জন্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ তারিখটা বেছে নিয়েছিল কারণ সে বিশ্বাস করত এটা তার জন্যে একটি শুভদিন। দুই বছর আগে এই দিনে সে আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমাতা পেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধাবেলা পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে দিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে বলেছিল, ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে! গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা আছে সেই নীল নকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট, সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে কেমন করে আলাপ আলোচনার ভান করে কালক্ষেপণ করা হবে, কীভাবে বাঙালি সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করা হবে, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করা হবে, সোজা কথায়, কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। শহরের প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে দেরি হবে তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাত সাড়ে এগারোটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের কাজ শুরু করে দিল। শুরু হলো পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ, এই হত্যাযজ্ঞের যেন কোনো সাক্ষী না থাকে সেজন্যে সকল বিদেশী সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তারপরেও সাইমন ড্রিং নামে একজন অত্যন্ত দুঃসাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা শহরে লুকিয়ে এই ভয়াবহ গণহত্যার খবর ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন।
ঢাকা শহরের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পাকিস্তান মিলিটারি সব বাঙালি অফিসারকে হয় হত্যা না হয় গ্রেপ্তার করে নেয়, সাধারণ সৈন্যদের নিরস্ত্র করে রাখে। পিলখানায় ই.পি. আরদেরকেও নিরস্ত্র করা হয়েছিল, তারপরেও তাদের যেটুকু সামর্থ্য ছিল সেটি নিয়ে সারারাত যুদ্ধ করেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়নি এবং এই পুলিশবাহিনীই সবার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সত্যিকার একটি যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেক ক্ষতি স্বীকার হয়ে পিছিয়ে গিয়ে ট্যাংক, মর্টার, ভারী অস্ত্র, মেশিনগান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
২৫ মার্চের বিভীষিকার কোনো শেষ নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) আর জগন্নাথ হলের সব ছাত্রকে হত্যা করল। হত্যার আগে তাদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে একটি গর্ত করা হয়, যেখানে তাদের মৃতদেহকে মাটি চাপা দেয়া হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের দৃশ্যটি বুয়েটের প্রফেসর নূর উল্লাহ তাঁর বাসা থেকে যে ভিডিও করতে পেরেছিলেন, সেটি এখন ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে, পৃথিবীর মানুষ চাইলেই নিজের চোখে সেটি দেখতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ছাত্রদের নয় সাধারণ কর্মচারী এমনকি শিক্ষকদেরকেও তারা হত্যা করে। আশেপাশে যে বস্তিগুলো ছিল সেগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে মেশিনগানের গুলিতে অসহায় মানুষগুলোকে হত্যা করে। এরপর তারা পুরানো ঢাকার হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো আক্রমণ করে, মন্দিরগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। যারা পালানোর চেষ্টা করেছে সবাইকে পাকিস্তান মিলিটারি গুলি করে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ ঢাকা শহর ছিল নরকের মতো, যেদিকে তাকানো যায় সেদিকে আগুন আর আগুন, গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার।
অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। আগেই খবর পেয়ে তিনি তাঁর দলের সব নেতাকে সরে যাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে বসে রইলেন নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যে।
স্বাধীন বাংলাদেশ
কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাবার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহবান জানিয়ে গেলেন। তাঁর ঘোষণাটি তৎকালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। যখন ঘোষণাটি প্রচারিত হয় তখন মধ্যরাত পার হয়ে ২৬ মার্চ হয়ে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ।
পাঁচদিন হরতালের পর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে এলেন। ততদিনে পুরো পূর্ব পাকিস্তান চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর ভাষণ শুনতে এসেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আক্ষরিক অর্থে একটি জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ভাষণ খুব বেশি দেয়া হয়নি। এই ভাষণটি সেদিন দেশের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অকাতরে প্রাণ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জুগিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে একদিকে যখন সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে অন্যদিকে প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে পাকিস্তান মিলিটারির গুলিতে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। পাকিস্তান মিলিটারির গতিবিধি থামানোর জন্যে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পথে পথে ব্যারিকেড গড়ে তুলছে। সারাদেশে ঘরে ঘরে কালো পতাকার সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। দেশের ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। মাওলানা ভাসানী ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে বলে দিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেন আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে। ঠিক এই সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণহত্যার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠাল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বিচারপতি তাকে গভর্নর হিসেবে শপথ করাতে রাজি হলেন না। ইয়াহিয়া খান নিজে মার্চের ১৫ তারিখ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে, এর মাঝে প্রত্যেক দিন বিমানে করে ঢাকায় সৈন্য আনা হতে থাকে। যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে, কিন্তু জনগণের বাধার কারণে সেই অস্ত্র তারা নামাতে পারছিল না। ২১ মার্চ এই ষড়যন্ত্রে ভুট্টো যোগ দিল, সদলবলে ঢাকা পৌঁছে সে আলোচনার ভান করতে থাকে। এদিকে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে বসে। তাদের থামানোর জন্যে ঢাকা থেকে যে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় তাদের সাথে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস, কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট আর গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া সারা বাংলাদেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া গেল না। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসাতেও সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো।
পরদিন ২৪ মার্চ, সারাদেশে একটি থমথমে পরিবেশ মনে হয় এই দেশের মাটি, আকাশ, বাতাস আগেই গণহত্যার খবরটি জেনে গিয়ে গভীর আশষ্কায় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে ছিল।
গণহত্যার শুরু : অপারেশন সার্চলাইট
গণহত্যার জন্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ তারিখটা বেছে নিয়েছিল কারণ সে বিশ্বাস করত এটা তার জন্যে একটি শুভদিন। দুই বছর আগে এই দিনে সে আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমাতা পেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধাবেলা পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে দিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে বলেছিল, ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে! গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা আছে সেই নীল নকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট, সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে কেমন করে আলাপ আলোচনার ভান করে কালক্ষেপণ করা হবে, কীভাবে বাঙালি সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করা হবে, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করা হবে, সোজা কথায়, কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। শহরের প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে দেরি হবে তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাত সাড়ে এগারোটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের কাজ শুরু করে দিল। শুরু হলো পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ, এই হত্যাযজ্ঞের যেন কোনো সাক্ষী না থাকে সেজন্যে সকল বিদেশী সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তারপরেও সাইমন ড্রিং নামে একজন অত্যন্ত দুঃসাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা শহরে লুকিয়ে এই ভয়াবহ গণহত্যার খবর ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন।
ঢাকা শহরের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পাকিস্তান মিলিটারি সব বাঙালি অফিসারকে হয় হত্যা না হয় গ্রেপ্তার করে নেয়, সাধারণ সৈন্যদের নিরস্ত্র করে রাখে। পিলখানায় ই.পি. আরদেরকেও নিরস্ত্র করা হয়েছিল, তারপরেও তাদের যেটুকু সামর্থ্য ছিল সেটি নিয়ে সারারাত যুদ্ধ করেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়নি এবং এই পুলিশবাহিনীই সবার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সত্যিকার একটি যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেক ক্ষতি স্বীকার হয়ে পিছিয়ে গিয়ে ট্যাংক, মর্টার, ভারী অস্ত্র, মেশিনগান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
২৫ মার্চের বিভীষিকার কোনো শেষ নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) আর জগন্নাথ হলের সব ছাত্রকে হত্যা করল। হত্যার আগে তাদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে একটি গর্ত করা হয়, যেখানে তাদের মৃতদেহকে মাটি চাপা দেয়া হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের দৃশ্যটি বুয়েটের প্রফেসর নূর উল্লাহ তাঁর বাসা থেকে যে ভিডিও করতে পেরেছিলেন, সেটি এখন ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে, পৃথিবীর মানুষ চাইলেই নিজের চোখে সেটি দেখতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ছাত্রদের নয় সাধারণ কর্মচারী এমনকি শিক্ষকদেরকেও তারা হত্যা করে। আশেপাশে যে বস্তিগুলো ছিল সেগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে মেশিনগানের গুলিতে অসহায় মানুষগুলোকে হত্যা করে। এরপর তারা পুরানো ঢাকার হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো আক্রমণ করে, মন্দিরগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। যারা পালানোর চেষ্টা করেছে সবাইকে পাকিস্তান মিলিটারি গুলি করে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ ঢাকা শহর ছিল নরকের মতো, যেদিকে তাকানো যায় সেদিকে আগুন আর আগুন, গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার।
অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। আগেই খবর পেয়ে তিনি তাঁর দলের সব নেতাকে সরে যাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে বসে রইলেন নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যে।
স্বাধীন বাংলাদেশ
কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাবার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহবান জানিয়ে গেলেন। তাঁর ঘোষণাটি তৎকালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। যখন ঘোষণাটি প্রচারিত হয় তখন মধ্যরাত পার হয়ে ২৬ মার্চ হয়ে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ।
পূর্ব পাকিস্তান
নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরদিনের জন্যে মুছে গেল,
জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বাংলাদেশ তখনো
ব্যথাতুর, যন্ত্রণাকাতর। তার মাটিতে তখনো রয়ে গেছে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর দানবেরা।
প্রতিরোধ আর প্রতিরোধ
ঢাকা শহরে পৃথিবীর একটি নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ২৭ মার্চ সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলে শহরের ভয়ার্ত নারী-পুরুষ-শিশু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের দিকে ছুটে যেতে লাগল। জেনারেল টিক্কা খান ভেবেছিল সে যেভাবে ঢাকা শহরকে দখল করেছে, এভাবে সারা বাংলাদেশকে এপ্রিলের দশ তারিখের দশ তারিখের মাঝে দখল করে নেবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি সম্ভব হলো না। বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা, এই দেশের ছাত্র-জনতা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার কোনো তুলনা নেই।
ঢাকা শহরে পৃথিবীর একটি নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ২৭ মার্চ সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলে শহরের ভয়ার্ত নারী-পুরুষ-শিশু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের দিকে ছুটে যেতে লাগল। জেনারেল টিক্কা খান ভেবেছিল সে যেভাবে ঢাকা শহরকে দখল করেছে, এভাবে সারা বাংলাদেশকে এপ্রিলের দশ তারিখের দশ তারিখের মাঝে দখল করে নেবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি সম্ভব হলো না। বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা, এই দেশের ছাত্র-জনতা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার কোনো তুলনা নেই।
চট্টগ্রামে
বাঙালি সেনাবাহিনী এবং ই.পি.আর বিদ্রোহ করে শহরের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান
চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে আবার
স্বাধীনতা ঘোষণা পড়ে শোনান। এই ঘোষণাটি সেই সময় বাংলাদেশের সবার ভেতরে নতুন একটি অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ
নেয়ার জন্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যুদ্ধেজাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করতে হয় এবং বিমান
আক্রমণ চালাতে হয়। বাঙালি যোদ্ধাদের হাত থেকে চট্টগ্রাম শহরকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী
কুষ্টিয়া এবং পাবনা শহর প্রথমে দখল করে নিলেও বাঙালি সৈন্যরা তাদের সম্পূর্ণভাবে
ধ্বংস করে শহরগুলো পুনর্দখল করে এপ্রিলের মাঝামাঝি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। বগুড়া দিনাজপুরেও একই ঘটনা
ঘটে। বাঙালি সৈন্যরা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে শহরগুলোকে পুনর্দখল করে নেয়। যশোরে বাঙালি সৈনদের নিরস্ত্র
করার চেষ্টা করার সময় তারা বিদ্রোহ করে, প্রায় অর্ধেক সৈন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারালেও বাকিরা
ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত হয়ে আসতে পারে। কুমিল্লা, খুলনা ও সিলেট
শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিজেদের দখলে রাখলেও বাঙালি সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে
ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই সময়ে পাকিস্তান থেকে দুইটি ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনী আনা হয়, তার সাথে সাথে আনা হয় যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র আর গোলা বারুদ। বিশাল অস্ত্রসম্ভার এবং বিমানবাহিনীর সাহায্যে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি তারা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বড় বড় শহর নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে পারে।
পাকিস্তান সরকার ১১ এপ্রিল টিক্কা খানের পরিবর্তে জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজীকে সশস্ত্রবাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্যে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই সময়ে পাকিস্তান থেকে দুইটি ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনী আনা হয়, তার সাথে সাথে আনা হয় যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র আর গোলা বারুদ। বিশাল অস্ত্রসম্ভার এবং বিমানবাহিনীর সাহায্যে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি তারা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বড় বড় শহর নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে পারে।
পাকিস্তান সরকার ১১ এপ্রিল টিক্কা খানের পরিবর্তে জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজীকে সশস্ত্রবাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্যে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
শরণার্থী
২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু করার পর বাংলাদেশে কেউই নিরাপদ ছিল না। তবে আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাগ ছিল সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারে এরকম তরুণেরাও সেনাবাহিনার লক্ষ্যবস্তু ছিল। সবচেয়ে বেশি আতষ্কের মাঝে ছিল কমবয়সী মেয়েরা। সেনাবাহিনীর সাথে সাথে বাংলাদেশের বিহারি জনগোষ্ঠীও বাঙালি নিধনে যোগ দিয়েছিল এবং তাদের ভয়ংকর অত্যাচারে এই দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী পাশের দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। জাতিসংঘ কিংবা নিউজ উইকের হিসেবে মোট শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। সে সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যাই ছিল মাত্র সাত কোটি যার অর্থ দেশের প্রতি সাতজন মানুষের মাঝে একজনকেই নিজের দেশ ও বাড়িঘর ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
ভারত এই বিশাল জনসংখ্যাকে আশ্রয় দিয়েছিল, কিন্তু তাদের ভরণপোষণ করতে গিয়ে প্রচন্ড চাপের মাঝে পড়েছিল। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আগরতলায় মোট অধিবাসী থেকে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল বেশি। শরণার্থীদের জীবন ছিল খুবই কষ্টের, খাবার অভাব, থাকার জায়গা নেই, রোগে শোকে জর্জরিত, কালেরা ডায়রিয়া এরকম রোগে অনেক মারা যায়। ছোট শিশু এবং বৃদ্ধদের সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, যুদ্ধ শেষে কোনো কোনো শরণার্থী ক্যাম্পে একটি শিশুও আর বেঁচে নেই।
২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু করার পর বাংলাদেশে কেউই নিরাপদ ছিল না। তবে আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাগ ছিল সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারে এরকম তরুণেরাও সেনাবাহিনার লক্ষ্যবস্তু ছিল। সবচেয়ে বেশি আতষ্কের মাঝে ছিল কমবয়সী মেয়েরা। সেনাবাহিনীর সাথে সাথে বাংলাদেশের বিহারি জনগোষ্ঠীও বাঙালি নিধনে যোগ দিয়েছিল এবং তাদের ভয়ংকর অত্যাচারে এই দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী পাশের দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। জাতিসংঘ কিংবা নিউজ উইকের হিসেবে মোট শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। সে সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যাই ছিল মাত্র সাত কোটি যার অর্থ দেশের প্রতি সাতজন মানুষের মাঝে একজনকেই নিজের দেশ ও বাড়িঘর ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
ভারত এই বিশাল জনসংখ্যাকে আশ্রয় দিয়েছিল, কিন্তু তাদের ভরণপোষণ করতে গিয়ে প্রচন্ড চাপের মাঝে পড়েছিল। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আগরতলায় মোট অধিবাসী থেকে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল বেশি। শরণার্থীদের জীবন ছিল খুবই কষ্টের, খাবার অভাব, থাকার জায়গা নেই, রোগে শোকে জর্জরিত, কালেরা ডায়রিয়া এরকম রোগে অনেক মারা যায়। ছোট শিশু এবং বৃদ্ধদের সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, যুদ্ধ শেষে কোনো কোনো শরণার্থী ক্যাম্পে একটি শিশুও আর বেঁচে নেই।
বাংলাদেশ সরকারঃ
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্খা এই দেশের মানুষের বুকের মাঝে জাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যে মানুষটি এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে তাঁদের নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে ৩০ মার্চ সীমান্ত পাড়ি দেয়। তখন তাঁর সাথে অন্য কোনো নেতাই ছিলেন না, পরে তিনি তাঁদের সবার সাথে যোগাযোগ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এপ্রিলের ১০ তারিখ মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সনদ ঘোষণা করা হয়। এই সনদটি দিয়েই বাংলাদেশ নৈতিক এবং আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই নতুন রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রথম দায়িত্ব বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে যাওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা।
পালটা আঘাত
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধেগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন এবং অপ্রস্তুত। ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সংগঠিত করে পালটা আঘাত হানতে শুরু করে। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব দেয়া হয় কর্নেল অবঃ এম.আতাউল গণি ওসমানীকে, চিফ অফ স্টাফ করা হয় লে. কর্ণেল আবদুর রবকে এবং ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে.খন্দকারকে। পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্খা এই দেশের মানুষের বুকের মাঝে জাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যে মানুষটি এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে তাঁদের নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে ৩০ মার্চ সীমান্ত পাড়ি দেয়। তখন তাঁর সাথে অন্য কোনো নেতাই ছিলেন না, পরে তিনি তাঁদের সবার সাথে যোগাযোগ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এপ্রিলের ১০ তারিখ মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সনদ ঘোষণা করা হয়। এই সনদটি দিয়েই বাংলাদেশ নৈতিক এবং আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই নতুন রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রথম দায়িত্ব বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে যাওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা।
পালটা আঘাত
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধেগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন এবং অপ্রস্তুত। ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সংগঠিত করে পালটা আঘাত হানতে শুরু করে। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব দেয়া হয় কর্নেল অবঃ এম.আতাউল গণি ওসমানীকে, চিফ অফ স্টাফ করা হয় লে. কর্ণেল আবদুর রবকে এবং ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে.খন্দকারকে। পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
Ø ১নং সেক্টরঃ চট্টগ্রাম,
পার্বত্য চট্টগ্রাম)
কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর জিয়াউর রহমান,
পরে মেজর রফিকুল ইসলাম।
Ø ২নং সেক্টরঃ নোয়াখালি,
কুমিল্লা, দক্ষিণ ঢাকা, আংশিক ফরিদপুর) কমান্ডার প্রথমে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ, তারপর ক্যাপ্টেন আব্দুস সালেক চৌধুরী এবং সবশেষে ক্যাপ্টেন এ.টি.এম হায়দার।
Ø ৩নং সেক্টরঃ উত্তর ঢাকা,
সিলেট ও ময়মনসিংহের অংশবিশেষ)
কমান্ডার প্রথমে ছিলেন মেজর কে.এম সফিউল্লাহ এবং তারপর মেজর এ.এন.এম. নুরুজ্জামান।
Ø ৪, ৫ এবং ৬নং সেক্টরঃ যথাক্রমে দক্ষিণ সিলেট, উত্তর সিলেট এবং
রংপুর, দিনাজপুর) কমান্ডার যথাক্রমে মেজর সি.আর.দত্ত, মেজর মীর শওকত
আলী এবং উইং কমান্ডার এম.কে বাশার।
Ø ৭নং সেক্টরঃ রাজশাহী,
বগুড়া, পাবনা) কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক, একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পর মেজর কাজী নুরুজ্জামান সেক্টর কমান্ডারের
দায়িত্ব নেন।
Ø ৮নং সেক্টরঃ কুষ্টিয়া,
যশোর, ফরিদপুর) কমান্ডার প্রথমে ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, এবং তারপর মেজর এম.এ মনজুর।
Ø ৯নং সেক্টরঃ খুলনা,
বরিশাল)
কমান্ডার ছিলেন মেজর এম.এ.জলিল)।
Ø ১০নং সেক্টর ছিল নৌ-অঞ্চলের জন্যে, সেটি ছিল সরাসরি
কমান্ডার ইন চিফের অধীনে। কোনো অফিসার ছিল না বলে এই সেক্টরের কোনো কমান্ডার ছিল না। নৌ-কমান্ডোরা যখন যে সেক্টরে তাদের অভিযান চালাতেন, তখন সেই সেক্টর কমান্ডারের অধীনে কাজ করতেন। এই নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন জ্যাকপটের অধীনে একটি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ
নিয়ে আগস্টের ১৫ তারিখ চট্টগ্রামে অনেকগুলো জাহাজ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
Ø ১১নং সেক্টরের (টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ) কমান্ডার ছিলেন মেজর এম.আবু তাহের, নভেম্বরে একটি
সম্মুখযুদ্ধে আহত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এর দায়িত্ব পালন করেন।
এই এগারোটি
সেক্টর ছাড়াও জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ
এবং শফিউল্লাহর নেতৃত্বে তাঁদের ইংরেজি নামের অদ্যাক্ষর ব্যবহর করে জেড ফোর্স,
কে ফোর্স এবং এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড তৈরি করা হয়। এছাড়াও টাঙ্গাইল আব্দুল কাদের
সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি অঞ্চলভিত্তিক বাহিনী ছিল। তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে তিনি
যে শুধু কাদেরিয়া বাহিনী নামে একটি অত্যনত্ম সুসংগঠিত বাহিনী গড়ে পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তা নয়, এই বাহিনীকে সাহায্য করার জন্যে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। যুদ্ধের শেষের দিকে
সশস্ত্রবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীও যোগ দিয়েছিল এবং এই যুদ্ধে প্রথম বিমান আক্রমণের কৃতিত্বও ছিল
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারির নাকের ডগায় ঢাকা শহরে দুঃসাহসিক গেরিলা অপারেশন করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ক্র্যাক প্লাটুন নামে দুঃসাহসী তরুণ গেরিলাযোদ্ধার একটি দল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সত্যিকার অর্থে একটি জনযুদ্ধ। এই দেশের অসংখ্য ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক যোগ দেয় সমতল ও পাহাড়ী আদিবাসী মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে জুতো কিংবা গায়ে কাপড় ছিল না, প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিল না এমনকি যুদ্ধ করার জন্যে প্রশিক্ষণ নেবার সময় পর্যন্ত ছিল না। খালেদ মোশাররফের ভাষায়, যুদ্ধক্ষেত্রেই তাদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। তাদের বুকের ভেতরে ছিল সীমাহীন সাহস আর মাতৃভূমির জন্যে গভীর মমতা। বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী যখন প্রচলিত পদ্ধতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাথে যুদ্ধ করেছে, তখন এই গেরিলাবাহিনী দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদেরকে বাধ্য করেছে তাদের গতিবিধি নিজেদের ঘাঁটির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে।
এই মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা বলে কখনো শেষ করা যাবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারের নিজেদের লেখা বইয়ে একটি ছোট কাহিনী এরকম: ১৯৭১ সালের জুন মাসে রাজশাহীর রোহনপুর এলাকায় একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। শত অত্যাচারেও সে মুখ খুলছে না। তখন পাকিস্তানি মেজর তাঁর বুকে স্টেনগান ধরে বলল, আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও, তা না হলে তোমাকে আমি গুলি করে মেরে ফেলব। নির্ভীক সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা নিচু হয়ে মাতৃভূমির মাটিতে শেষবারের মতো চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত। আমার রক্ত আমার প্রিয় দেশটাকে স্বাধীন করবে। এই হচ্ছে দেশপ্রেম, এই হচ্ছে বীরত্ব এবং এই হচ্ছে সাহস। এঁদের দেখেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানত এই দেশটিকে তারা কখনোই পরাজিত করতে পারবে না, আগে হোক পরে হোক, পরাজয় স্বীকার করে তাদের এই দেশ ছেড়ে যেতেই হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি, কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধাদের মতোই অবদান রেখেছিল, সেরকম প্রতিষ্ঠানটির নাম হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাহায্যে এই বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশের অবরুদ্ধ জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেই সময়ের অনেক দেশের গান এখনো বাংলাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানের কথা আলাদা করে না বললে ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাঁদের সাহায্য সহযোগিতা জন্যোই মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করতে পেরেছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, এমনকি অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারির নাকের ডগায় ঢাকা শহরে দুঃসাহসিক গেরিলা অপারেশন করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ক্র্যাক প্লাটুন নামে দুঃসাহসী তরুণ গেরিলাযোদ্ধার একটি দল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সত্যিকার অর্থে একটি জনযুদ্ধ। এই দেশের অসংখ্য ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক যোগ দেয় সমতল ও পাহাড়ী আদিবাসী মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে জুতো কিংবা গায়ে কাপড় ছিল না, প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিল না এমনকি যুদ্ধ করার জন্যে প্রশিক্ষণ নেবার সময় পর্যন্ত ছিল না। খালেদ মোশাররফের ভাষায়, যুদ্ধক্ষেত্রেই তাদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। তাদের বুকের ভেতরে ছিল সীমাহীন সাহস আর মাতৃভূমির জন্যে গভীর মমতা। বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী যখন প্রচলিত পদ্ধতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাথে যুদ্ধ করেছে, তখন এই গেরিলাবাহিনী দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদেরকে বাধ্য করেছে তাদের গতিবিধি নিজেদের ঘাঁটির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে।
এই মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা বলে কখনো শেষ করা যাবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারের নিজেদের লেখা বইয়ে একটি ছোট কাহিনী এরকম: ১৯৭১ সালের জুন মাসে রাজশাহীর রোহনপুর এলাকায় একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। শত অত্যাচারেও সে মুখ খুলছে না। তখন পাকিস্তানি মেজর তাঁর বুকে স্টেনগান ধরে বলল, আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও, তা না হলে তোমাকে আমি গুলি করে মেরে ফেলব। নির্ভীক সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা নিচু হয়ে মাতৃভূমির মাটিতে শেষবারের মতো চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত। আমার রক্ত আমার প্রিয় দেশটাকে স্বাধীন করবে। এই হচ্ছে দেশপ্রেম, এই হচ্ছে বীরত্ব এবং এই হচ্ছে সাহস। এঁদের দেখেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানত এই দেশটিকে তারা কখনোই পরাজিত করতে পারবে না, আগে হোক পরে হোক, পরাজয় স্বীকার করে তাদের এই দেশ ছেড়ে যেতেই হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি, কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধাদের মতোই অবদান রেখেছিল, সেরকম প্রতিষ্ঠানটির নাম হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আমাদের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাহায্যে এই বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশের অবরুদ্ধ জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেই সময়ের অনেক দেশের গান এখনো বাংলাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানের কথা আলাদা করে না বললে ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাঁদের সাহায্য সহযোগিতা জন্যোই মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করতে পেরেছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, এমনকি অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন।
যৌথবাহিনীঃ
জুলাই মাসের দিকে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করে অক্টোবর মাসের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী দেখতে দেখতে শক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্ডার আউটপোস্টগুলো নিয়মিতভাবে আক্রমণ করে দখল করে নিতে শুরু করে। গেরিলাবাহিনীর আক্রমণও অনেক বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের জবাব দিত রাজাকারদের নিয়ে গ্রামের মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে আর স্থানীয় মানুষদের হত্যা করে। ততদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়তে শুরু করেছে, তারা আর সহজে তাদের ঘাঁটির বাইরে যেতে চাইত না।
বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখতে দেখতে এত খারাপ হয়ে গেল যে পাকিস্তান তার সমাধান খুঁজে না পেয়ে ডিসেম্বরে তিন তারিখ ভারত আক্রমণ করে বসে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ আক্রমণ করে ভারতের বিমানবাহিনীকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেবে, কিন্তু সেটি করতে পারল না। ভারত সাথে সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের ভেতর তখন পাকিস্তানের পাঁচটি পদাতিক ডিভিশন। যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আক্রমণের জন্য তিনগুণ বেশি অর্থাৎ ১৫ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ভারতীয়রা মাত্র আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করার সাহস পেয়েছিল। কারণ তাদের সাথে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী। সেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এর মাঝেই পুরোপুরি অচল করে রাখতে পেরেছিল। শুধু যে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তা নয় এই যুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষও ছিল যৌথবাহিনীর সাথে। যুদ্ধ শুরু হবার পর সেটি চলেছে মাত্র তেরো দিন। একেবারে প্রথম দিকেই বোমা মেরে এয়ারপোর্টগুলো অচল করে দেবার পর পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের সব পাইলট পালিয়ে গেল পাকিস্তানে। সমুদ্রে যে কয়টি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ছিল সেগুলো ডুবিয়ে দেবার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাকি রইল শুধু তার স্থলবাহিনী। নিরীহ জনসাধারণ হত্যা করতে তারা অসাধারণ পারদর্শী কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে কেমন করে, সেটি দেখার জন্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একটি একটি করে পাকিস্তানের ঘাঁটির পতন হতে থাকল। তারা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে অল্পকিছু জায়গায় মাটি কামড়ে পড়ে রইল। ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তিবাহিনী তাদেরকে পাশ কাটিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঢাকার কাছাকাছি এসে হাজির হয়ে যায়। মেঘনা নদীতে কোনো ব্রিজ ছিল না, সাধারণ মানুষ তাদের নৌকা দিয়ে সেনাবাহিনীকে তাদের ভারী অস্ত্রসহ পার করিয়ে আনল!
ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী এবং তার জেনারেলরা বাংলাদেশের যুদ্ধে টিকে থাকার জন্যে যে দুটি বিষয়ের ওপর ভরসা করছিল, সেগুলো ছিল অত্যন্ত বিচিত্র। প্রথমত, তারা বিশ্বাস করত পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধে তারা ভারতকে এমনভাবে পর্যুদস্ত করবে যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর সরে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি থাকবে না। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে তাদের সাহায্য করার জন্যে উত্তর দিক থেকে আসবে চীনা সৈন্য আর দক্ষিণ দিক থেকে আসবে আমেরিকান সৈন্য। কিন্তু দেখা গেল, তাদের দুটি ধারণাই ছিল পুরোপুরি ভুল। পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে পাকিস্তানিরাই চরমভাবে পর্য্যুদস্ত হলো আর কোনো চীনা বা আমেরিকান সৈন্য তাদের সাহায্যে জন্যে এগিয়ে এল না!
আত্মসমর্পণঃ
মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্যে আহবান করল। গভর্নর হাউসে বোমা ফেলার কারণে তখন গভর্নর মালেক আর তার মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটনে) আশ্রয় নিয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ লিফলেট ফেলেছে, সেখানে লেখা’ মুত্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো।
ঢাকার ‘পরম পরাক্রশালী’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিল। আত্মসমর্পণের দলিলে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করার কথাটি দেখে একজন পাকিস্তান জেনারেল দুর্বলভাবে একবার সেখান থেকে বাংলাদেশের নামটি সরানোর প্রস্তাব করেছিল কিন্তু কেউ তার কথাকে গুরুত্ব দিল না, ইতিহাসে সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই!
১৬ ডিসেম্বর বিকেল বেলা রেসকোর্স ময়দানে হাজার হাজার মানুষের সামনে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নেয়ার দলিলে স্বাক্ষর করল। যে বিজয়ের জন্যে এই দেশের মানুষ সুদীর্ঘ নয় মাস অপেক্ষা করছিল সেই বিজয়টি এই দেশের স্বজন হারানো সাতকোটি মানুষের হাতে এসে ধরা দিল।
বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় পাকিস্তানের সব সৈন্য আত্মসমর্পণ করে শেষ করতে করতে ডিসেম্বরের ২২ তারিখ হয়ে গেল।
জুলাই মাসের দিকে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করে অক্টোবর মাসের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী দেখতে দেখতে শক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্ডার আউটপোস্টগুলো নিয়মিতভাবে আক্রমণ করে দখল করে নিতে শুরু করে। গেরিলাবাহিনীর আক্রমণও অনেক বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের জবাব দিত রাজাকারদের নিয়ে গ্রামের মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে আর স্থানীয় মানুষদের হত্যা করে। ততদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়তে শুরু করেছে, তারা আর সহজে তাদের ঘাঁটির বাইরে যেতে চাইত না।
বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখতে দেখতে এত খারাপ হয়ে গেল যে পাকিস্তান তার সমাধান খুঁজে না পেয়ে ডিসেম্বরে তিন তারিখ ভারত আক্রমণ করে বসে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ আক্রমণ করে ভারতের বিমানবাহিনীকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেবে, কিন্তু সেটি করতে পারল না। ভারত সাথে সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের ভেতর তখন পাকিস্তানের পাঁচটি পদাতিক ডিভিশন। যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আক্রমণের জন্য তিনগুণ বেশি অর্থাৎ ১৫ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ভারতীয়রা মাত্র আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করার সাহস পেয়েছিল। কারণ তাদের সাথে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী। সেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এর মাঝেই পুরোপুরি অচল করে রাখতে পেরেছিল। শুধু যে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তা নয় এই যুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষও ছিল যৌথবাহিনীর সাথে। যুদ্ধ শুরু হবার পর সেটি চলেছে মাত্র তেরো দিন। একেবারে প্রথম দিকেই বোমা মেরে এয়ারপোর্টগুলো অচল করে দেবার পর পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের সব পাইলট পালিয়ে গেল পাকিস্তানে। সমুদ্রে যে কয়টি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ছিল সেগুলো ডুবিয়ে দেবার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাকি রইল শুধু তার স্থলবাহিনী। নিরীহ জনসাধারণ হত্যা করতে তারা অসাধারণ পারদর্শী কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে কেমন করে, সেটি দেখার জন্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একটি একটি করে পাকিস্তানের ঘাঁটির পতন হতে থাকল। তারা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে অল্পকিছু জায়গায় মাটি কামড়ে পড়ে রইল। ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তিবাহিনী তাদেরকে পাশ কাটিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঢাকার কাছাকাছি এসে হাজির হয়ে যায়। মেঘনা নদীতে কোনো ব্রিজ ছিল না, সাধারণ মানুষ তাদের নৌকা দিয়ে সেনাবাহিনীকে তাদের ভারী অস্ত্রসহ পার করিয়ে আনল!
ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী এবং তার জেনারেলরা বাংলাদেশের যুদ্ধে টিকে থাকার জন্যে যে দুটি বিষয়ের ওপর ভরসা করছিল, সেগুলো ছিল অত্যন্ত বিচিত্র। প্রথমত, তারা বিশ্বাস করত পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধে তারা ভারতকে এমনভাবে পর্যুদস্ত করবে যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর সরে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি থাকবে না। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে তাদের সাহায্য করার জন্যে উত্তর দিক থেকে আসবে চীনা সৈন্য আর দক্ষিণ দিক থেকে আসবে আমেরিকান সৈন্য। কিন্তু দেখা গেল, তাদের দুটি ধারণাই ছিল পুরোপুরি ভুল। পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে পাকিস্তানিরাই চরমভাবে পর্য্যুদস্ত হলো আর কোনো চীনা বা আমেরিকান সৈন্য তাদের সাহায্যে জন্যে এগিয়ে এল না!
আত্মসমর্পণঃ
মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্যে আহবান করল। গভর্নর হাউসে বোমা ফেলার কারণে তখন গভর্নর মালেক আর তার মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটনে) আশ্রয় নিয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ লিফলেট ফেলেছে, সেখানে লেখা’ মুত্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো।
ঢাকার ‘পরম পরাক্রশালী’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিল। আত্মসমর্পণের দলিলে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করার কথাটি দেখে একজন পাকিস্তান জেনারেল দুর্বলভাবে একবার সেখান থেকে বাংলাদেশের নামটি সরানোর প্রস্তাব করেছিল কিন্তু কেউ তার কথাকে গুরুত্ব দিল না, ইতিহাসে সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই!
১৬ ডিসেম্বর বিকেল বেলা রেসকোর্স ময়দানে হাজার হাজার মানুষের সামনে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নেয়ার দলিলে স্বাক্ষর করল। যে বিজয়ের জন্যে এই দেশের মানুষ সুদীর্ঘ নয় মাস অপেক্ষা করছিল সেই বিজয়টি এই দেশের স্বজন হারানো সাতকোটি মানুষের হাতে এসে ধরা দিল।
বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় পাকিস্তানের সব সৈন্য আত্মসমর্পণ করে শেষ করতে করতে ডিসেম্বরের ২২ তারিখ হয়ে গেল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘঠিত গণহত্যার পরিসংখ্যানঃ
মুক্তিযুদ্ধের সময়
গণহত্যা চলাকলে কতজন মানুষ মারা গিয়েছে সে সম্পর্কে গণমাধ্যমে বেশ কয়েক ধরনের
সংখ্যা রয়েছে। যেমনঃ
Ø ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড আলমানাকে সংখ্যাটি ১০লক্ষ,
Ø ১৭৭২
সালে ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত
নিউইয়রক টাইম
অনুযায়ী ৫ থেকে ১৫ লক্ষ,
Ø কম্পটনস
এনসাইক্লোপিডিয়া এবং এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা অনুযায়ী সংখ্যাটি ৩০ লক্ষ।
তবে প্রকৃত সংখ্যাটি কত, সেটি সম্ভবত
কখনোই জানা যাবে না। তবে বাংলাদেশের এই সংখ্যাটি ৩০লক্ষ বলে অনুমান করা হয়।
তথ্য সূত্রঃ
৩. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (পৃষ্ঠা ১০-১১) - মুহম্মদ জাফর ইকবাল
৪.
List of Sectors in Bangladesh Liberation War
৭. ফিরে দেখা ৭১, Editor
and Published by Local talk, 1st Internet edition published on 12
july,2008
৮. মূল ধারা “৭১, মঈদুল হাসান।
৯. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র, ২য়
খন্ড।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন