জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৩

বিশ্বায়ন, তথ্যায়ন এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ – মাহাবুবুর রহমান

Globalization is not the only thing influencing events in the world today,

but to the extent that there is a North Star and

a worldwide shaping force, it is this system.

-Thomas Friedman, The Lexus and the Olive Tree,1999



ভূমিকা

ফ্রাইডম্যানের উল্লিখিত বক্তব্য বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক ও প্রাযুক্তিক শক্তিসমূহের গভীর গুরুত্বকেই নির্দেশ করে যা সমকালীন বিশ্বকে নতুনভাবে আমাদের সামনে চিত্রায়িত করছে। প্রকৃতপক্ষে সমকালীন গণমাধ্যম এবং বিশ্বায়নের তাত্ত্বিকদের মধ্যে ফ্রাইডম্যানই অন্যতম যিনি ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘তথ্যায়ন’ (Informatization) এই দুটি ধারণার শক্তির উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন যা ইতিমধ্যে শিল্পায়ন, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সম্ভবত সামাজিক শৃঙ্খলের অন্তর্নিহিত রীতি-নীতিকেও পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানরত বিভিন্ন সমাজ ও সমপ্রদায়ের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যা-ই থাকুক না কেন, ‘নয়া আন্তর্জাতিক তথ্য শৃঙ্খলে’ সে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে একথা উল্লেখ্য যে, তাদের অংশগ্রহণের ধরন সুনির্দিষ্ট সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা দ্বারা সংজ্ঞায়িত। বৈশ্বিক এবং স্থানিক সীমার মধ্যে পরিব্যপ্ত বহুমাত্রিক জটিল এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে একটি যোগাযোগ প্রপঞ্চ হিসাবে কেবল মাত্র আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রেক্ষাপটই পরিবর্তন করে না বরং এর বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও সমভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।

কিন্তু সহজাতভাবে প্রশ্ন জাগে, মানবীয় জীবনের উপর সুগভীর প্রভাব রাখতে সক্ষম এমন শক্তিসমূহ প্রকৃত অর্থে কী? তথ্য-প্রযুক্তির যুগান্তকারী সম্ভাবনা এবং বিশ্বায়ন ইতিমধ্যে শিল্প-কারখানা বিশেষ করে আর্থিক বাজারের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের উপর এই শক্তিসমূহের প্রভাব কতখানি সেটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলোচনার দাবী রাখে। এছাড়া আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগীয় তত্ত্বসমূহ কীভাবে আমাদের এই শক্তিসমূহকে চিহ্নিত করতে ও বুঝতে সাহায্য করে সেটাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিবেচনার দাবী রাখে। বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের এ যুগে আবির্ভূত নয়া ইস্যুগুলোর সাথে ট্র্যাডিশনাল আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের ধারণা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটাও আলোচনা করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিশ্বকে নতুন করে রূপদানকারী উল্লিখিত শক্তিসমূহের সাথে আন্ত:সাংস্কৃতিক যোগাযোগের সম্পর্ক, বিপরীতে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লিখিত শক্তিসমূহের ভূমিকা এবং একই সঙ্গে উল্লিখিত শক্তিসমূহের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিকদের কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা ও পরিশেষে একটি বিশ্বায়িত প্রাযুক্তিক পৃথিবীকে বোঝার জন্য আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রভাব নিরূপণ করা এই আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।

বিশ্বায়ন ও তথ্যায়ন

অতিসাধারণীকরণ কিংবা ভুল উপস্থাপন- এই দুই ধরনের জটিলতা এড়ানোর জন্য প্রথমেই আমরা বিশ্বায়ন ও তথ্যায়ন এই প্রধান ধারণা দুটির সাথে পরিচিত হয়ে নিব। বিশ্বায়নকে এ যাবৎ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই যে কথাটা উঠে এসেছে তা হলো: বিশ্বায়ন এমন একটি ধারণা যা রাজনৈতিক বন্ধন, অর্থনৈতিক সর্ম্পক এমনকি কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং এর সাথে গভীরভাবে আন্তঃসম্পর্কিত। প্রাথমিকভাবে বিশ্বায়ন ধারণা বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো, বিশ্বায়ন এমন এক প্রক্রিয়া যার ফলে বিভিন্ন আর্থিক এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকাকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। Friedman[1] (১৯৯৯) এর মতে, বিশ্বায়নের ফলে বাজার, জাতি-রাষ্ট্র এমনকি প্রযুক্তির প্রসার এমন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে যা ইতিপূর্বে কখনোই পরিলক্ষিত হয় নি। Kennedy[2] (১৯৯৩), বিশ্বায়নকে মূলত অর্থনৈতিক টার্ম দিয়ে বিবেচনা করেছেন এবং তিনি বিশ্বায়নকে প্রাথমিকভাবে অর্থনীতির একটি বর্ধিত কাঠামো হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, সুস্পষ্টভাবে অর্থনৈতিক কাঠামোর বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় যেখানে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃত্ব করে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আসতে পারে বিভিন্ন বহুজাতিক কর্পোরেশন, সরকারি, আঞ্চলিক অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি।

যদিও বিশ্বায়নকে অনেকেই অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে এটি আরও বহু বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রাযুক্তিক ইত্যাদি বিশ্বের উপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। দেশীয় সীমানা পেরিয়ে পণ্য বিনিময় প্রথা শুরু হওয়ার পর থেকেই ধারণা, প্রথা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমন কি হালে রাজনৈতিক আন্দোলনসহ ইত্যাদি কোনোভাবেই আর জাতীয় সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকছে না।

বাস্তব চিত্র হিসেবে বিশ্বায়ন হলো, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বন্ধনসমূহ এবং নতুন ধাঁচের এক অর্থনৈতিক বাস্তবতা। আর অর্থ বিচারে বিশ্বায়ন হলো, ব্যাপক বাজারের সমপ্রসারণ, পুঁজি ও শিল্পের একত্রীকরণ। অবশ্য অনেকে এটাকে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ না বলে বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণের কথাই বলেছেন। ১৯৯৯ সালে সিয়াটলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে দাঙ্গার পর থেকে অনেকেই বিশ্বায়ন ধারণার পুরোপুরি সমর্থক নয়। সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন যে, বিশ্বায়ন প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য বৃদ্ধি করছে, পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশ্বায়ন জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে আন্তর্জাতিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং মূলত দেশীয় নীতির উপর বহুজাতিক সংস্থাগুলোর অনভিপ্রেত আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে।

তথ্যায়ন বলতে এখানে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝানো হচ্ছে যার মাধ্যমে নয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসমূহ যেমন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কিংবা অন্যান্য যোগাযোগ প্রযুক্তিসমূহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের মাত্রাকে এমন মাত্রায় নিয়ে গেছে যাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাঁধাগুলো ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। Masuda[3] বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে বলেছেন, নয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্ভাবন বিদ্যমান সমাজ ও সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে এবং তা মৌলিকভাবেই বিদ্যমান অবস্থা থেকে পৃথক হবে। তার মতে, শিল্পায়ন পরবর্তী তথ্যভিত্তিক সমাজে শিল্প-প্রযুক্তি নয় বরং জ্ঞান ও তথ্য-পণ্য উৎপাদই হবে সমাজের মূল চালিকাশক্তি। উপরন্তু প্রাযুক্তিক সমকেন্দ্রিকতা নতুন এমন আরও অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যা মানবিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

Wang[4] (১৯৯৪) তথ্যায়নকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তথ্যায়ন হলো পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া যা নিম্নলিখিত দুইটি বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে আছে। যথা: ১. এটা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের এমন এক মাত্রা নির্দেশ করে যেখানে তথ্য-প্রযুক্তি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশীল চালিকাশক্তি। ২. তথ্যায়ন হলো তথ্য উৎপাদন ও বণ্টনের গতি, পরিমাণ ও গুণগত মানের এক অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি। ইউএনডিপির (২০০১) এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যেখানে ১৯৯৯ সালে বিশ্বে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়ন সেখানে ২০০১ সালে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল ৭০০ মিলিয়নে। Internet world Status এর ২০১১ সালের মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২০৭২ মিলিয়নে। তথ্য ব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণের ফলে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি আর স্থানীয় বা জাতীয় কোনো সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ নেই।

অন্যদিকে নেতিবাচকভাবে যদি দেখি, তাহলে বিশ্বায়ন ও তথ্যায়ন এই দুই শক্তি বিশ্বের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য, স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতি এক ধরনের ভয়াবহ হুমকি তৈরি করেছে। উদাহরণ হিসাবে বলে রাখি, ইন্টারনেটের প্রায় শতভাগ তথ্যই ইংরেজিতে এবং কেউ যদি ইন্টারনেটের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই ইংরেজীতে ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করতে হবে।[5]এতে দেশীয় ভাষায় মানুষের দখল কমে গিয়ে আস্তে আস্তে সে বিশ্বায়িত ইংরেজি ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ২০০০ সালে জাপানের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্যানেল ইংরেজিকে ভবিষ্যতে জাপানের অফিসিয়াল ভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। উপরন্তু বিশ্বায়ন এমন এক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছে যার ফলে বৃহৎ পুঁজিপতিরাই আজ বিশ্ব অর্থনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকতে পারছে, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে গিলে খাচ্ছে বহুজাতিক কর্পোরেশনের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। ফ্রাইডম্যান এটাকে এমন এক ব্যবস্থা হিসাবে অভিহিত করেছেন, যেখানে ‘সবকিছু বিজয়ীর’। বলা যায়, প্রযুক্তি খেলার মাঠকে মসৃণ করেছে কিন্তু প্রতিযোগীদের মাঝে কোনো সমতা নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। আজ বিশ্বের অধিকাংশ বাণিজ্যিক সাইটগুলোর নিয়ন্ত্রণই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। প্রযুক্তির সামগ্রিক উৎপাদন ও প্রায় এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো। সংক্ষেপে বলা যায়, টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের এই আধিপত্য বর্তমানে আমাদের সামনে সুস্পষ্ট। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আমাদের সামনে আরও সুস্পষ্ট হবে। ২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনেই সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের তুলনায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি[6]। আর ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে উঁচুতে এবং এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা হলো ১৬৮,০০০,০০০ যা প্রায় বিশ্বের শীর্ষ বাকি নয়টি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেশের সমান। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের সহজলভ্যতার ফলে আজ বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ আরও ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, উদ্ভাবিত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের নতুন নতুন কৌশল।

বিশ্বায়ন, তথ্যায়ন এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন

এক্ষেত্রে প্রথমেই যে প্রশ্নটি বিস্তৃতভাবে আমাদের আলোচনা করা দরকার তা হলো বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব কী এবং পরবর্তীতে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের সাথে তাদের সম্পর্ক কী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিকরা আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ তত্ত্বের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এরকম বিষয় যেমন, ক্রিটিক্যাল থিওরি অথবা ঔপনিবেশিক যুগ পরবর্তী লিটারেরি থিওরি ইত্যাদিকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন। যা-ই হোক আমার এই আলোচনায় সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বিবেচনাযোগ্য তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা উত্থাপন করা হবে:
সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণায়ন ।
বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের এ যুগে কীভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সূচিত হয়।
ব্যক্তি এবং সমপ্রদায়ের আত্নপরিচয় নির্ধারনে বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের ভূমিকা কী।

নিশ্চিতভাবেই আমরা বলতে পারি সংস্কৃতি একটি বিমূর্ত ধারণা। এমন কি আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের বিভিন্ন তত্ত্বতেও সংস্কৃতিকে সুনির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হয় নি। বৈশিষ্ট্যগতভাবে এটি একটি প্রতীকী প্রক্রিয়া যা পারস্পারিক উপলব্ধি, অবধারণা এবং অনুধাবন ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটা অবশ্যই কোনো অঞ্চলের লোকজ ধারণা বা উৎসবের সঙ্গেই শুধুমাত্র সম্পৃক্ত নয়। Greetz[7] সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় বলেন, এটা একগুচ্ছ প্রতীকী ব্যবস্থার সমষ্টি যা কেবল সংস্কৃতি এবং সামাজিক কাঠামোকেই উল্লেখ করে না বরং মানব সংস্কৃতির দুটো জরুরী অংশ: সামাজিক মূল্যবোধ এবং ব্যক্তির ভুবনদৃষ্টিকে ছন্দোবদ্ধ করে। একটা কথা উল্লেখ করা দরকার, প্রকৃতপক্ষে গ্রিটজ এখানে সংস্কৃতিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা খুবই এলোমেলো এবং তিনি এক্ষেত্রে সামগ্রিক ধারণার ব্যবহার করছেন যা সহজভাবে সংস্কৃতিকে বুঝতে সাহায্য করে না। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রতিটি সুনির্দিষ্ট কার্য, বাচনভঙ্গি এবং চিন্তা বিসতৃত আকারে এবং বৃহৎ পরিসরে আমাদেরকে বুঝতে হবে।

বিশ্বায়ন নিশ্চিতভাবেই সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের অনুধাবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের অবতারণা করেছে। আমাদের অনেকের মধ্যেই সংস্কৃতির সঙ্গে জাতির ধারণাকে গুলিয়ে ফেলে চিন্তা করতে দেখা যায়। সংস্কৃতির শিক্ষক কিংবা গবেষকরাও প্রায়ই আলোচনার ক্ষেত্রে বলে ফেলেন রাশিয়ান সংস্কৃতি, জাপানি সংস্কৃতি, চীনা সংস্কৃতি, বাংলাদেশি সংস্কৃতি ইত্যাদি। কিন্তু একটি জাতীয় সীমার মধ্যে সংস্কৃতির যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ থাকতে পারে তা প্রায়ই তারা উল্লেখ করেন না। আসলে জাতি হলো একটি রাজনৈতিক ধারণা যার মধ্যে সংস্কৃতি হলো একটি প্রতীকী ব্যবস্থা। জাতির সংজ্ঞায়ন এবং সংস্কৃতির গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা। উদাহরণ হিসাবে চীনাদের কথা বলতে পারি যেখানে প্রায় ৮০টি ভিন্ন ভাষা-ভাষী গোত্র আছে যারা শুধুমাত্র ভাষাগত দিক থেকেই নয়; ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাতস্ত্রের দিক থেকেও পরস্পর পরস্পরের থেকে ভিন্ন। চীনের অফিসিয়াল ভাষা হলো মান্দারিন, অনেকেই আবার এটাকে চাইনিজ ভাষাও বলে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বেশির ভাগ চীনাদের কাছেই এটি প্রধান ভাষা নয়। চীনের প্রত্যেকটি আলাদা অঞ্চলের মানুষের আলাদা রীতি-নীতি ও বিশ্বাস আছে কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা এটা চীনা সংস্কৃতি বলে অভিহিত করে থাকি। বিশ্বায়িত এ যুগে যেখানে সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত প্রবাহমান বা পরিবর্তনশীল সেখানে কেবল রাজনৈতিক চেতনা উদ্বুদ্ধ ‘জাতি’ পরিচয় তার যৌক্তিকতা হারাচ্ছে। শুধু ‘জাতি’ পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে সংজ্ঞায়িত করলে সংস্কৃতিকে খুবই সংকীর্ণ আকারে ব্যাখ্যা করা হয়।

উল্লিখিত আলোচনার সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছু প্রশ্নের অবতারণা ঘটে। যেমন, শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ভিত্তিক জাতি ব্যবস্থায় সংস্কৃতির সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন কি আমাদের উপর বল প্রয়োগ করে? বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়ন কি সাংস্কৃতিক সমকেন্দ্রিকতা কিংবা বিকেন্দ্রিকরণ নিয়ে আসে? অর্থনৈতিক এবং প্রাযুক্তিক বিস্তারের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক বন্ধন কি বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের উপর সংস্কৃতির প্রভাবকে আরও সুস্পষ্ট করছে অথবা হ্রাস করছে? আন্তর্জাতিক মিথস্ক্রিয়া কিভাবে ব্যক্তির সাংস্কৃতিক আত্নপরিচয়ের উপর হুমকি সৃষ্টি করছে? কখন ইসরায়েলিরা দক্ষিণ আফ্রিকান ওয়েবসাইটগুলোতে কিংবা চীনারা জাপানি ওয়েব সাইটগুলোতে ঢুঁ মারে এবং কাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ বলব?

মজার ব্যাপার হলো এ জাতীয় প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ এগুলো আমাদের উপর আরও কতগুলো মৌলিক প্রশ্ন চাপিয়ে দেয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মিডিয়া নিজে কোনো অসাড় বা অক্রিয়াশীল সত্তা নয়। সাংস্কৃতিক ধারা, রীতি-নীতি মিডিয়ার আধেয়, প্রচার উপাদান, কাঠামো ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেয়। যেমন, কাতার ভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএনএনের মধ্যে তুলনা করলেই আমরা দেখতে পাব কোনটা সংবাদ আর কোনটা সংবাদ নয় সে সম্পর্কে উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। পার্থক্য আছে তাদের সংবাদ নির্বাচন এবং উপস্থাপন বৈচিত্রের মধ্যে। এবং লক্ষণীয়, উভয়ের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আদর্শও ভিন্ন।

প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় আসে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়নের ভূমিকা কতটুকু। তাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, বিশ্বায়ন মূলত কেন্দ্রমুখিভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের কেন্দ্র হলো পশ্চিম এবং পশ্চিমা ধারণাকে সমজাতীয়করণ করতেই বিশ্বায়ন ক্রিয়াশীল রয়েছে। ট্র্যাডিশনাল এবং বিবর্তনবাদী উভয় ঘরানার তাত্ত্বিকরাই মনে করেন সাংস্কৃতিক এবং জাতীয় সীমারেখার মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় সমকেন্দ্রীকরণ করার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক উন্নত দেশগুলোতে নতুন ধরনের পুঁজিবাদের উত্থানকে প্রায়ই সার্বজনীনতা, জাতি, বর্ণ, স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন চেহারা হিসাবে সাধুবাদ দেয়া হয়ে থাকে।[8] আরেকটু এগিয়ে বললে, ভৌগলিক ও রাজনৈতিক সীমানা ছাপিয়ে একটা নতুন ধরনের সংস্কৃতির সৃষ্টি হচ্ছে যাকে আমরা পেশাদারিত্ব, প্রাযুক্তিক দক্ষতা এবং সামাজিক শ্রেণী দিয়ে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি।

আবার অনেকেই বলছেন, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের উপর বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়নের প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক এবং এর ফলে অবাধ ভোগবাদীতার উদ্ভব হয়েছে যা প্রথাগত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণ হিসাবে ১৯৯৯ সালে চীনের সংবাদমাধ্যমে একজন চীনা পন্ডিতের বক্তব্যের দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। তিনি বলছেন, বিদেশি পণ্যের অন্ধ পুজা, দেশপ্রেমিক বীরদের অবমূল্যায়ন, বিদ্বান সমাজের আধিপত্য, জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে ছাড় এগুলোর সবই হচ্ছে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির কাছে চীনের বশ্যতা স্বীকারের লক্ষণ[9]। অন্য কথায়, বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির যে বিশ্বায়ন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যসহ ব্যাঙের ছাতার মতো রাস্তার মোড়ে গজিয়ে ওঠা সাইবার ক্যাফে এসব আসলে বিশ্ব সাংস্কৃতিক চরিত্রের ব্যাপক মাত্রার পরিবর্তনকেই নির্দেশ করে।


সংস্কৃতির সমজাতীয়করণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়ন খুব স্বাভাবিকভাবে এমন কিছু দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব ঘটায় যা বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ধারণার সাথে বেমানান। উদাহরণ হিসেবে প্রশ্ন রাখা যায়, আরবের ইতিহাস এবং ভাষা থেকে জন্ম নেয়া ইসলাম ধর্ম বিশ্বায়ন তাড়িত উত্তর আধুনিকতার সাথে খাপ খায় কি? মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ইসলামের শিকড় বিস্তৃত হয়েছে কিন্তু পরিবর্তনশীল বিশ্বায়িত ভবিষ্যতের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। Ahmed[10] মনে করেন, ভুবনদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় ইসলাম পরিবর্তনশীল বিশ্বে একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে পারে। সংস্কৃতি চর্চার অংশ হিসেবে বিশ্বায়ন ইসলামিক সমাজগুলোতে এক ধরনের টেনশন তৈরি করেছে যেমন, মুসলিম যুবকদের বিশ্বায়িত ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিত করে তোলে (যা মুসলিম বিশ্বের সংস্কৃতির সাথে কোনোভাবেই মেলে না) যা প্রথাগত মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক উত্তেজনার সঞ্চার করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে, ১৯৯০’র দশকে ইন্দোনেশিয়ার একটি জরিপের কথা উল্লেখ করা যায়। যেখানে দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়ার যুবকদের কাছে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর চেয়ে মাইকেল জ্যাকসন বেশি জনপ্রিয় এবং জরিপের ফলাফল নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন সাংবাদিককে কারাবরণ করতে হয়েছিল[11]।

এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করলে বিশ্বায়ন ও তথ্যায়ন স্থানীয় প্রথা ও সংস্কৃতির উপর কেন্দ্রবহির্মুখ শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এটা কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতির মানুষকে অন্যান্য সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রথাগত রীতি-নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় মিডিয়াগুলোও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে নিজেদের বক্তব্য বিশ্ববাসীর সামনে মেলে ধরতে পারছে। তাদের বার্তাগুলোকে চাইলেই আর কেউ ছাঁচিকরণ করতে পারছে না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজ বিশ্বের যে কোন অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যে কেউ কোন দুর্গম অঞ্চলে বসেও তথ্য পেতে পারে।

উল্লিখিত ধারণা বিশেষজ্ঞদের সামনে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি জটিল ইস্যুর অবতারণা করে। আর এটা হলো মেরুকরণের ফলে কিভাবে ব্যক্তির স্থানীয় এবং গোত্রীয় পরিচয় নির্ধারিত হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের মুল্যবোধ খুবই সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে ব্যক্তি পুনঃবার মেরুকরণের মুখোমুখি হতে পারে। এমন বক্তব্যের পেছনে আমি পাঠকের সামনে অন্তত তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি উত্থাপন করতে পারব।

প্রথমত, মানুষ সাধারণত নিজেকে কোনো সম্প্রদায় বা জাতির সদস্য মনে না করে ব্যক্তিক সংকীর্ণ পরিচয়ে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। সেটা হতে পারে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় কিংবা ভাবার্দশের প্রতি অনুরক্ত হয়ে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করলে দেখা যায়, আমরা যতই বৈশ্বিক হই না কেন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ততই আঞ্চলিক হয়ে থাকে। আমরা যদিও কোনো সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস, জীবনধারা কিংবা সামাজিক ধারণা গ্রহণ করতে বাধ্য নই। কিন্তু সেই সাথে কোনো বিশ্বাস বা মূল্যবোধকে গ্রহণ করার জন্য কারো পক্ষ থেকে আমাদের উপর কোনো চাপও থাকে না।

দ্বিতীয়ত, ব্যাপক ধরনের তথ্য প্রবেশগম্যতার ফলে কোন ব্যক্তি আর তথ্যের জন্য তার নিজস্ব কম্যুনিটি কিংবা সমাজের উপর নির্ভর করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশের ফলে এখন যে কেউ অনলাইনের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্ম বা বিশ্বাস সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করতে পারে এবং চাইলে নিজস্ব ধর্ম বা কম্যুনিটির বাইরে গিয়ে অন্য বিশ্বাসে দীক্ষিত হতে পারে। এটা আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য মারাত্মকভাবে হুমকি স্বরুপ। বলা বাহুল্য যোগাযোগ প্রযুক্তির এই বিপ্লব মানুষের সামনে চিন্তার স্বধীনতার দ্বার আরও বেশি করে উন্মুক্ত করেছে। খ্রিস্টান মিশনারিসমূহ ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানোর উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইট খুলেছে। ইসলাম, বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্মগুলোও নিজেদের ধর্মের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য ক্রমানয়ে ইন্টারনেট অভিমুখি হচ্ছে এবং এটা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসে মানুষের সহজ প্রবেশাধিকারের জন্য নয় বরং মানুষকে দীক্ষিত করানোর জন্য। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ধারণাই বিদ্যমান। কেউ যদি খুব সহজেই গোত্রীয় সীমার বাইরে গিয়ে আলাদা মতাদর্শে নিজেকে সন্নিবেশিত করে নতুন আত্মপরিচয় তৈরি করতে পারে তাহলে সে কখনোই আর কোন বিষয়ে সমর্থনের জন্য কম্যুনিটির উপর নির্ভর করবে না। সাইবার প্রতিবেশি যখন স্থানীয় প্রতিবেশির মতোই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে তখন উভয়ের মধ্যে আর দূরত্ব তেমন একটা থাকবে না।

সব শেষে বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়ন যে বিশ্বাসকে ধারণ করে আছে এবং উৎসাহিত করছে তা হলো ব্যক্তিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং আত্মপরিচয়ের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং নতুন আত্মপরিচয়ে দীক্ষিত করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওয়েবের মাধ্যমে আজকে প্রান্তিক বিশ্বাসের প্রতি আস্থাশীল একজন মানুষ বৃহৎ জনগোষ্ঠী সম্পন্ন কোনো বিশ্বাসের প্রতি অনুরক্ত হতে পারে। কারণ সমাজে সাধারণত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বা বিশ্বাসগুলোই বৃহৎ সংখ্যক অনুগামী গঠনে সক্ষম। মনে রাখা ভালো, এরকম একটি অবস্থা কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক ঐক্যের পরিবর্তে সামাজিক সংহতিকে নষ্টও করে দিতে পারে। সামাজিকভাবে কোনো ধর্মীয় গুরুর কাছে গিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করা কিংবা নতুন বিশ্বাসের প্রতি অনুগামী হওয়া এক বিষয় আর সামাজিক সমর্থন ছাড়া অন্য বিশ্বাসে দীক্ষিত হওয়া আলাদা বিষয়। এটা বরং ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান নষ্ট করে থাকে।

সংক্ষেপে বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে পরিবর্তন তার সঙ্গে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ তাত্ত্বিকদের ধারণায়ন অন্তত তিনভাবে সম্পর্কিত। সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন কিভাবে উল্লিখিত প্রবণতাগুলোর প্রসার করে এবং ব্যক্তির আত্মপরিচয় এবং সামাজিক ঐক্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়ন এই দুই শক্তির ভূমিকা ইত্যাদি যোগাযোগ তাত্ত্বিকদের আলোচনার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদেরকে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরি ও বুঝতে সাহায্য করে।

বিশ্বায়ন, তথ্যায়ন এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ

বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় একটি বিষয় আমাদের সামনে সুস্পষ্ট যে, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ তত্ত্বের ভিত্তি নির্মাণ এবং বিশেষভাবে সংস্কৃতি, সমাজ এবং যোগাযোগ সম্পর্কে আমাদের অনুধাবনকে সুস্পষ্ট করার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন ও তথ্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমি এক্ষেত্রে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের ধরন ও চর্চার উপর বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়নের প্রভাব ও ভূমিকা নিয়ে কিছু ক্রিটিক্যাল ইস্যু নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। এক্ষেত্রে আমি শুধুমাত্র তিনটি ইস্যুর অবতারণা করব। অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন জাগতে পারে এমন ক্রিটিক্যাল একটি বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি বিষয় যথেষ্ট কিনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এ তিনটি বিষয়ই আলোচ্য বিষয়ের উপর আরও অধিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট করবে বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। বিশেষ করে আমি এক্ষেত্রে কম্পিউটারভিত্তিক যোগাযোগ এবং অন্যান্য যোগাযোগ ইস্যুর উপর সংস্কৃতির প্রভাব, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যে প্রতিশ্রুতি তা পূরণে যোগাযোগ প্রযুক্তিসমূহের কার্যকারিতা এবং পেশাগত সাফল্যের উপর আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ দক্ষতার ভূমিকা নিয়ে আলোচনার অবতারণা করতে চাই।

খুব বেশি মাত্রায় না হলেও প্রাথমিকভাবে আন্তঃব্যক্তিক আচরণের মধ্যে দিয়ে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। তথ্যায়ন আমাদেরকে বার্তার সফল বিচ্ছুরণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির প্রভাবকে বিবেচনায় রাখতে সহায়তা করে যার ফলে প্রথাগত চ্যানেলগুলোর তুলনায় বর্তমানে ব্যাপক সফল ও কার্যকরভাবে বার্তা প্রবাহিত হচ্ছে। যোগাযোগীয় আচরণের উপর সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আস্তে আস্তে টেলিযোগাযোগ, সাইবার স্পেস এবং মিডিয়ার সম্ভাব্য অন্যান্য ধারাগুলো ধীরে ধীরে যোগাযোগের জনপ্রিয় চ্যানেলে পরিণত হচ্ছে। যোগাযোগের বিভিন্ন ধরন এবং কম্পিউটারভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তি মূখ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। মনে রাখা উচিত, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য প্রযুক্তির এই সুবিধা ভিন্ন ভিন্ন[12]। যদিও বাস্তবতা হলো সাংস্কৃতিক সীমার মধ্যেই নয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে খুবই কম গবেষণা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত সহজ একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চাই। একজন সাধারণ জাপানি যুবক কি সিএনএনের ওয়েবসাইটের প্রতি একইভাবে সাড়া দেয়, যতটা দেয় একজন পাকিস্তানি যুবক? যেহেতু যোগাযোগের বিকাশের ক্ষণ থেকেই তার সঙ্গে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ইস্যুগুলো জড়িত। তাই যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশের ফলে আমরা নতুন কোন জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি কিনা সেটা অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে।

আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগকে আমরা কীভাবে অধ্যয়ন করছি তার উপর এই ইস্যুর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। নয়া যোগাযোগ পরিমন্ডলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগের ক্ষেত্রে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক ধারণা যেমন, উচ্চ কিংবা নিচু মাত্রার সাংস্কৃতিক পার্থক্য ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত উচ্চমাত্রার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল বলতে বোঝায় যেখানে সামাজিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং যোগাযোগ প্রক্রিয়ার ধরন উন্নত কিন্তু কথা হলো সেই পরিমন্ডলেও কি প্রযুক্তি ব্যবহারকারী একজন যুবক সাইবার স্পেস থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন প্রণোদনাকে সহজে মোকাবেলা করতে পারে? যেহেতু অবাচনিক আচরণ আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগকে জটিল করে তোলে, তাহলে প্রাযুক্তিক চ্যানেলগুলো কি বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগকে সহজ করে দেয়? ইলেকট্রনিক যোগাযোগের ফলে কি নতুন ধরনের কোনো অবাচনিক আচরণের সৃষ্টি হচ্ছে? নতুন এই প্রেক্ষাপটে কোন কোন ইস্যুগুলো ব্যক্তির যোগাযোগ দক্ষতা নির্মাণ করে এবং নির্ধারণ করে ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরকে আসলেই খুঁজে বের করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান করলে উদ্ভূত ইস্যুর সংখ্যা সীমাহীন হবে যা আমাদের চিন্তার জায়গা, শিক্ষণ, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ দক্ষতা ও তত্ত্ব ইত্যাদিতে মৌলিকভাবে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি বৈশ্বিক মূল্যবোধ, প্রযুক্তি এবং যোগাযোগের সমকেন্দ্রিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট। এটা হলো যোগাযোগ প্রযুক্তির সেই সামর্থ্য যা আন্তঃসাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়াকে উৎসাহ যোগাতে এবং নয়া রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কার্যকারিতা উন্নয়নে প্রযুক্তির প্রতিশ্রুতিকে পরিপূর্ণ করে। নিশ্চিতভাবেই এ কথা সত্যি যে, প্রাযুক্তিক প্রাচুর্য্যের কারণেই বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সদস্যদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সহজাত প্রশ্ন জাগে প্রযুক্তির সাথে মিথস্ক্রিয়ার সময় মানুষ কি সেই বৈচিত্র্যকে খুঁজে বের করে অথবা প্রাথমিক পর্যায়েও কি ব্যবহারকারী সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সংস্কৃতির লোকদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে? এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানের একটি উদ্ধৃতি দিতে পারি। তিনি বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি প্রযুক্তির শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ক্ষমতা আছে যা বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হবে। নয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণ ও গুণগত মান নাটকীয়ভাবে প্রতিদিন, প্রতিটি দেশে এমনকি বিশ্বের প্রতিটি কোণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন নিয়ে আসছে। আর এর ফলে নাগরিকদের তথ্যে প্রবেশগম্যতার হারও অনেক বেড়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মাত্রাও অনেক বেড়েছে[13]।

যদিও উল্লিখিত আকাঙ্খা, যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ইঙ্গিত করে কিন্তু তা আদৌ কতখানি সম্ভব সেটা আমাদের কাছে এখনও সুস্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ দিই। ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েন-আন-মেন স্কয়ারে গণতন্ত্রের লক্ষ্যে যে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছিল সে সময় উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে অবস্থানরত চীনা পন্ডিত, ছাত্র ও সাধারণ মানুষেরা ইন্টারনেট ও লভ্য সকল যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা সেই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু ওয়েবসাইট কি সেদিন তার কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পেরেছিল? বাস্তবতা হলো, পারে নি। ওয়েবসাইটে তিব্বতিয়দের বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের লক্ষ্যে যে প্রচারণা তা কি বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভূমিকা রেখেছে। নয়া প্রযুক্তির ফলে কি পরিমাণ মানুষ অন্য ধর্ম থেকে বৌদ্ধ ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে?

উত্তর খোঁজার ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে আমি এখন এক্ষেত্রে তৃতীয় আলোচ্য ইস্যুটির অবতারণা করব। তৃতীয় ইস্যুটি হলো ব্যক্তির আচরণ যার ফলে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাফল্য আসে। বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের ফলে নতুন এক জ্ঞান সমাজের উদ্ভব হয়েছে যা কেবলমাত্র নয়া তথ্য-বাণিজ্যে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই পরিচিত। এই শ্রেণী আর প্রথাগত শিল্প কারখানা কিংবা কৃষির উপর নির্ভরশীল নয়। পিটার ড্রাকারের একটি উক্তি এক্ষেত্রে খেয়াল করা যেতে পারে। তিনি বলছেন, আনুষ্ঠানিক জ্ঞানের অর্জন ও বন্টনের মাধ্যমে যে কোন জ্ঞান সমাজের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পারে। সম্পদ ও আয়ের এই উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা গত দু থেকে তিন শতক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে যাকে আমরা পুঁজিবাদ নামে অভিহিত করে থাকি।[14]

অধিকন্তু বার্তার আদান-প্রদান এক ধরনের যোগাযোগীয় দক্ষতা যা একজন ব্যক্তি, সংস্থা, শিল্প কিংবা কোনো একটি জাতি কতটা সফলভাবে জ্ঞানের উৎপাদন ও বণ্টন করতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেয়। এবং এর উপরই নির্ভর করে অর্জিত সফলতা তারা কতখানি বিসতৃত করতে পারবে বর্তমান বৈশ্বিক গণমাধ্যম ব্যবস্থায় যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক ইস্যূগুলোর সমন্বয় খুব সহজ নয় এবং এটা নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতামূলক। সম্ভবত নতুন এই জ্ঞান সমাজ ট্র্যাডিশনাল জাতীয় বা সাংস্কৃতিক সীমানা পেরিয়ে নতুন নতুন জ্ঞান, দক্ষতা এবং ভুবনদৃষ্টির সমকেন্দ্রিকরণের মুখোমুখি হবে।

যাই হোক জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই একটি আপেক্ষিক ধারণা[15]। যেমনটা Drucker[16] বলেছেন, জ্ঞান সমাজের বিদ্যা তখনই কার্যকর হবে যখন সেটাকে কাজে প্রয়োগ করা হবে। এটা কখনোই অবস্থা নিরপেক্ষ নয়। যা একজনের কাছে জ্ঞান তা আরেকজনের কাছে তথ্য মাত্র। যেমন, বাংলাদেশী কোন বিজনেস এক্সিকিউটিভকে সিউলে কাজ করতে হলে কোরিয়ান ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে এটা হলো এক ধরনের তথ্য। কিন্তু কিছুদিন পর সেই এক্সিকিউটিভ যখন কোরিয়াতে সত্যি সত্যি তার বাণিজ্য সমপ্রসারণ করতে চায় তখন সেই তথ্যটি তার কাছে জ্ঞান। ড্রাকার মনে করেন, বর্তমান তথ্য সমাজে জ্ঞান এবং তথ্যের মধ্যে যে স্বাতস্ত্র্য সেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। এমনকি বর্তমান পৃথিবীতে কারো গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানও কখনো কখনো খুব সাধারণ মানের তথ্য হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। বিদ্যমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় জ্ঞান সমাজে অংশগ্রহণকারীরা সব সময়ই জ্ঞানের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে এবং নিজের অভিষ্ট লক্ষ্যে আসলে কখনোই পৌঁছাতে পারে না যেখানে পৌঁছালে তাদের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু জানতে পারে।

পরিশেষ

এই নিবন্ধে আমার লক্ষ্য ছিলো আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে বিশ্বায়ন ও তথ্যায়নের প্রভাব অনুসন্ধান করা। নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আজকের বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো ভবিষ্যতের বাস্তবতায় তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। নতুন নতুন ঘটনা প্রবাহ এসে বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর স্থান দখল করে নেবে। তারপরও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পৃথিবীকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়নের যে প্রভাব এবং এ শক্তিদ্বয় কীভাবে শুধু আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের ভিত্তি কাঠামোকে নয় বরং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। এ বিষয়ে তাত্ত্বিকদের সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হওয়া একান্ত আবশ্যক বলে আমি মনে করি।

আমি খুব সংক্ষিপ্ত একটি বক্তব্যের মাধ্যমে এই নাতিদীর্ঘ রচনার ইতি টানতে চাই যা ভবিষ্যতে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ তাত্ত্বিকদের উল্লিখিত ইস্যূসমূহকে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে এবং প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে সহায়তা করতে পারে। সম্ভবত আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের তাত্ত্বিক ও গবেষকরা জ্ঞানের অন্যান্য বাতাবরণের তাত্ত্বিকদের চেয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন এই অর্থে যে, জ্ঞানের প্রথাগত বাতাবরণের বিভিন্ন কাঠামোগুলো বিদ্যমান নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়ন এই দ্বৈত শক্তিকে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ তাত্ত্বিকদের প্রদত্ত কাঠামো দিয়ে বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ এই বাতাবরণটি শুরু থেকেই সংস্কৃতির বৈশ্বিক ধারণাগত ও আচরনগত পরিবর্তনের সাথে এবং ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তনে যোগাযোগের ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিকশিত হয়েছে। তাই পরিবর্তিত বিশ্বের সংস্কৃতি ধারণাকে যথাযথভাবে বোঝার জন্য আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ তাত্ত্বিকরা একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেন। যোগাযোগ তাত্ত্বিকরা খুব ভালোভাবে জানেন যে, সংস্কৃতি একটি প্রতীকী প্রক্রিয়া এবং প্রতীকগুলো প্রকৃতির একটি ঘনিষ্ঠ নিরীক্ষা। এই প্রতীকগুলোর পরিবর্তন ও প্রভাব ব্যক্তিকে বুঝতে সাহায্য করে তথ্যায়ন ও বিশ্বায়ন কিভাবে আমাদের জীবনধারাকে কাঠামো প্রদান করে এবং জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রতীকী অনুধাবনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর সম্ভবত এর মাধ্যমেই পরিবর্তিত বাস্তবতায় আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের উপর বিশ্বায়ন এবং তথ্যায়নের প্রভাব সর্ম্পকে আমাদের ধারণা সুস্পষ্ট হবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক।


তথ্যসূত্র

[1]. Friedman, T. (1999). The lexus and the olive tree: understanding globalization.New York: Farrar, Straus, Giroux.

[2] Kennedy, P. (1993). Preparing for the twenty-first century.New York: Random House.

[3]. Masuda, Y. (1982) Information Society as Post-Industrial Society. Bethesda, MD: World Future Society.

[4]. Wang, G. (1994). Treading different paths: informatization in Asian nations. Norwood,NJ: Ablex.

[5]. Barber, B. (1995). Jihad vs. McWorld: how globalism and tribalism are reshaping the world.New York: Random House.

[6]. World Bank, (2000). Statement on Global Knowledge.New York.

[7]. Geertz, C. (1973). The interpretation of cultures.New York: Basic Books.

[8]. Robison, R. and Goodman, D. S. G. (Eds.). (1996). The New rich in Asia: mobile phones, McDonald’s, and middle-class revolution.London andNew York: Routledge.

[9]. Lee. Z. (1999). Contention on the issue of ‘colonial culture.’ Chinese Sociology and Anthropology, 31, 4, 8-14.

[10]. Ahmed, A. S. (1992). Postmodernism and Islam: Predicament and Promise.London: Routledge.

[11]. Hitching, B. (1996) McDonalds, Minarets, and Modernity: The anatomy of the emerging secular Muslim world.Sevenoaks,Kent,UK: Spear Publishing.



[12]. Jackson, M. (1997) Assessing the structure of communication on the world wide web. Journal of Computer Mediated Communication, 3, 1.

[13]. United Nations. (1998, March 24). Secretary General says communications technology has great democratizing power waiting to be harnessed to global struggle for peace and development. United Nations Press Release SG/SM/6502 SAG/4.New York.

[14]. Drucker, P. (1994, November). The age of social transformation. The Atlantic Monthly, 274. (5). 53-80.

[15]. Breen, M.(1997). Information does not equal knowledge. Journal of Computer Mediated Communication, 3 (3).

[16]. Drucker, P. (1994, November). The age of social transformation. The Atlantic Monthly, 274. (5). 53-80.


সহায়ক গ্রন্থ

Chen, G. and Starosta, W.(2000). Communication and global society. New York: Peter Lang.

Ellul, J. (1965). Propaganda: the formation of men’s attitudes.New York: Knopf.

“English ‘imperialism:’ the Japanese have more to gain than lose by learning the language. (2000, April 7). Asiaweek, 26. (13). 21.

Geertz, C. (1973). The interpretation of cultures.New York: Basic Books.

Geertz, C. (1983). Local knowledge: further essays in interpretive anthropology.New York: Basic Books.

Hitching, B. (1996) McDonalds, Minarets, and Modernity: The anatomy of the emerging secular Muslim world.Sevenoaks,Kent,UK: Spear Publishing.

Jackson, M. (1997) Assessing the structure of communication on the world wide web. Journal of Computer Mediated Communication, 3, 1.

Kennedy, P. (1993). Preparing for the twenty-first century.New York: Random House.

Lee. Z. (1999). Contention on the issue of ‘colonial culture.’ Chinese Sociology and Anthropology, 31, 4, 8-14.

Lopez, D. (1998). Prisoners of Shangri-la: Tibetan buddhism and the west.Chicago:University ofChicago Press.

Masuda, Y. (1982) Information Society as Post-Industrial Society. Bethesda, MD: World Future Society.

Poster, M. (1999). National identities and communications technologies. The Information Society,15 (4), 235-240.

Robison, R. and Goodman, D. S. G. (Eds.). (1996). The New rich in Asia: mobile phones, McDonald’s, and middle-class revolution.London andNew York: Routledge.

Sprague, J. (2000, February 18). Asia’s worldly past: everything old is new again. Asiaweek, 26. (6).

United Nations. (1997, October 22). World must reap benefits of globalization without eroding cultural diversity, Republicof Koreatells second committee. United Nations press release GA/EF/2770.New York.

United Nations. (1998, March 24). Secretary General says communications technology has great democratizing power waiting to be harnessed to global struggle for peace and development. United Nations Press Release SG/SM/6502 SAG/4.New York.

United Nations Development Program. (1999). Human Development Report, 1999.New York.

USEmbassy report, (2000, January). China‘s Internet “Information Skirmish”.Beijing.

Wang, G. (1994). Treading different paths: informatization in Asian nations. Norwood,NJ: Ablex.

World Bank, (2000). Statement on Global Knowledge.New York.

World Bank, (2000). Statement on New Technology.New York .

Zhang, K. and Hao, X. (1999) The Internet and Ethnic Press: A Study of Electronic Chinese Publications. The Information Society, 15 (1). pp. 21-30.

1 টি মন্তব্য:

Mohammad Kamruzzaman বলেছেন...

প্রমান্য সংজ্ঞাগুলোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ঠ লেখকের পরিচয় আরেকটু বিস্তারিত হলে ভালো হতো।