‘Social Capital’- মূলত সমাজতত্ত্বের একটি ধারণা। এর সংজ্ঞায়নে বৈচিত্রতা লক্ষ্য
করা যায়। তবে
সব সংজ্ঞায়নের বক্তব্যই অনেকটা এমন, ‘Something of a cure-all for the
problem of modern society’. যেমন: কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষা স্ক্রু ড্রাইভারের মতো কাজ করে সমাজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
আলেজান্দ্রো
পোর্টেস (১৯৯৮) তার লেখায় ‘Social Capital’- এর উৎস এবং সংজ্ঞায়নকে
পর্যালোচনা করেছেন। তার
কাজে বিভিন্ন জনের লেখালেখির মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে বর্দু, লোঈ এবং কোলম্যানের কাজ। লেখাটিতে ‘Social Capital’- উৎসের
বিবেচনায় চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং এই উৎসগুলোর গতিশীলতাকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। গরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘Social Capital’- সম্পর্কিত
সাম্প্রতিক লেখালেখিগুলো ধারণাটিকে ব্যক্তিগত সম্পদের পরিসর থেকে সম্প্রদায়গত, এমনকি জাতীয় সম্পদের পরিসর
পর্যন্ত বি¯তৃত
করেছে। সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে সমাজতত্ত্বীয় পরিসর থেকে নিত্যদিনকার ভাষা বলয়ে রপ্তানী হওয়া ধারণাগুলোর
মধ্যে ‘Social Capital’- সবচেয়ে
জনপ্রিয় একটি ধারণা। তবে সাম্প্রতিক এই জনপ্রিয়তাকে পাশকাটিয়ে যদি একটু ভেতরে উঁকি দেওয়া
যায়, তাহলে দেখা যাবে, সমাজতাত্ত্বিকদের কাছে ‘Social Capital’-এর
ধারণা মোটেও নতুন কোন ধারণা নয়।
লক্ষ্যণীয়, ব্যক্তির দলে তথা দলীয় জীবনে
অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সমাজতাত্ত্বিক ডুর্খেইমের কাজে
আমরা দলীয় জীবনের অংশগ্রহণের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। ডুর্খেইম তার কাজে দেখান, দলীয় জীবনে গুরুত্ব প্রদান
ব্যক্তিজীবনে অস্বাভাবিকতা এবং আত্মনাশের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। আবার মার্ক্স তার আলোচনায় Class-in-itself এবং Class-for-itself – সম্পর্কিত
আলোচনার মধ্যদিয়ে Class-for-itself – কে
গতিশীল এবং কার্যকরী ধারণা হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা দলীয় অংশগ্রহণের গুরুত্বকে
তুলে ধরে। এ
সমস্ত দিক বিবেচনায় বলা যায়, ‘Social Capital’- সমাজতত্ত্বের প্রথমদিকের
অন্তঃবর্তী দর্শনকে স্রেফ পুর্নঃধারণায়ন করেছে।
পোর্টেস
তার লেখায় বলছেন যে, আমাদের
জন্য কিছূ প্রশ্ন করতে পারা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন:
কেন সাম্প্রতিক সময়ে ‘Social Capital’- এর ধারণা এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো? কিংবা কেন পলিসি বাস্তবায়নে
গতানুগতিক অন্যান্য অনুষঙ্গের ভিড়ে ‘Social Capital’- ঠাঁই করে নিলো?
‘Social Capital’- এর মহত্ব এবং অতীত
পুনর্মূল্যায়নের মধ্যদিয়ে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা মূলত দু’টি উৎস থেকে এসেছে।
প্রথমত: ‘Social Capital’- ধারণাটি
মূলত আলোকপাত করে সমাজ অন্তর্ভুক্তির ইতিবাচক দিকগুলোতে। পাশাপাশি এটি সমাজ অন্তর্ভুক্তির
ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম আকর্ষণীয় বিষয়গুলোকে একপাশে সরিয়ে রাখে।
দ্বিতীয়ত: এটি এর ইতিবাচক প্রভাবগুলোকে
পুঁজি সম্পর্কিত বি¯তৃত
আলোচনার ফ্রেমওয়ার্কে স্থাপন করে। এটি যেন বলে দেয়, “দেখুন, ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ
আর হৃষ্টপুষ্ট ব্যাংক এ্যাকাউন্টের বিবেচনায় পুঁজির অ-অর্থনৈতিক ধরন কতো
গুরুত্বপূর্ণ শক্তির আধার আর প্রভাব বিস্তারী হতে পারে।”
‘Social Capital’- এর সংজ্ঞায়ন সমূহ:
‘Social Capital’-এর নিয়মতান্ত্রিক ও সমসাময়িক
বিশ্লেষণটি সর্বপ্রথম এসেছে Pierre Bourdieu - কাছ থেকে। বর্দু ‘Social Capital’- সম্পর্কে
বলেন,
“সঠিক ও কার্যকরী সম্পদের সমাহার
এবং এই সম্পদগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী জালের মধ্যদিয়ে যুক্ত থাকে”। বর্দুর এই ধারণাটি প্রথম পাওয়া
১৯৮০-তে প্রকাশিত তার‘ Actes de la Recherche en Sciences Sociales’- গ্রন্থের ‘Provisional Notes’-এ। কিন্তু ফরাসী ভাষায় লিখা ছিল বলে
ইংরেজী ভাষাভাষিদের দুনিয়ায় বর্দুর এই প্রবন্ধটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত তেমন বিস্তৃতি
লাভ করেনি। লেখাটির
দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকা দুঃখজনক। কেননা, যারা
সমসাময়িক সমাজতাত্ত্বিক ডিসকোর্সের পরিসরে ‘Social Capital’- টার্মটি নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে বর্দুর বিশ্লেষণই
তত্ত্বীয়ভাবে সবচেয়ে পরিশোধিত। মূল লেখাতে বর্দু এভাবে বলছেন, “দলের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি যে মুনাফা অর্জন করে বা যে পরিমাণ লাভবান
হয়, সেগুলোই মূলত সৌহার্দ্র ও
ভ্রাতৃত্বের মূল ভিত্তি এবং দলে অংশগ্রহণই কেবল একে সম্ভপর করে তোলে”। Social Network - গুলো
প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু নয়। দলীয় সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে যে বিনিয়োগ কৌশল- তার মধ্যদিয়েই
মূলত Social Network-গুলো
নির্মিত।
বর্দুর সংজ্ঞা এ বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার
ধারণা দেয় যে, ‘Social Capital’-মূলত দু’টি উপাদানে বিভক্ত-
প্রথম: সামাজিক সম্পর্কগুলো নিজেই
ব্যক্তিকে দলের অন্যান্যদের আয়ত্ত্বে থাকা সম্পদের ব্যবহার দাবী করবার জায়গা করে
দেয়।
দ্বিতীয়: ‘Social Capital’- এর
দ্বিতীয় উপাদানটি হলো দলের আয়ত্ত্বে থাকা সম্পদের পরিমাণ এবং গুণগত মান।
‘Social Capital’- প্রসঙ্গে পিয়েরে বর্দু মূলত
বিভিন্ন ধরনের পুঁজির সমন্বয়নের কথা বলেন এবং ‘Social Capital’- থেকে সকল ধরনের অর্থনৈতিক পুঁজির
আলোচনা সরিয়ে ফেলবার কথা বলেন।
লেখক বলছেন, অনেক
ক্ষেত্রেই ‘Social Capital’- এর মধ্যদিয়ে এর এ্যাক্টরেরা
অর্থনৈতিক উৎসগুলোতে সরাসরি ব্যবহারাধিকার পেতে পারে। তারা দক্ষ কারোও সংস্পর্শে তাদের
সামাজিক পুঁজিকে বাড়াতে পারে। কিংবা তারা এমন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে পারে যার মধ্যদিয়ে তারা
মূল্যবান ক্রিডেন্সিয়াল (প্রাতিষ্ঠানীকিকৃত সাংস্কৃতিক পুঁজি) অর্জন করতে পারে। পোর্টেজ বলছেন, যদিও বর্দু অর্থনৈতিক পুঁজিকে
কমিয়ে আনবার কথা বলেন, তথাপি
‘Social Capital’- অর্জনের
জন্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক, দু’ধরনের বিনিয়োগেরই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
‘Social Capital’- এর দ্বিতীয় সাম্প্রতিক উৎস যার
কাজে খুঁজে পাওয়া যায় তিনি অর্থনীতিবিদ Glen Loury। লোঈর কাজ মূলত উঠে এসেছে আয়ের
বর্ণকেন্দ্রীক অসমতার নিও-ক্লাসিক্যাল তত্ত্বের সমালোচনার মধ্যদিয়ে। লোঈ বলছেন, গোঁড়া অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো
অনেকবেশি ব্যক্তিকন্দ্রীক। এর মূল ফোকাস ব্যক্তির মানব পুঁজি উপর এবং দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা
করবার লেভেল ফিল্ড তৈরি করবার প্রতি। লোঈ বলছেন, এই
অর্থনীতিবিদরা যখন চাকরীদাতাদের রেসিয়াল টেস্টের বিরুদ্ধে আইনী নিষেধাজ্ঞার কথা
বলেন, সমান সুযোগ বাস্তবায়নের কথা
বলেন- সেটা কোনভাবেই বর্ণ বৈষম্যকে কমাতে পারেনা। লোঈ বলছেন অন্তত দু’টি কারণে এই বর্ণ বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়।
প্রথমত: কৃষাঙ্গ পিতা-মাতার উত্তরাধিকার
সূত্রে প্রাপ্ত দারিদ্র্য তাদের সন্তানদের মধ্যেও প্রবাহিত হয়। কেননা সন্তানের জন্য রয়েছে নিচুমানের
বস্তুগত সম্পদ আর শিক্ষার সুযোগ।
দ্বিতীয়ত: যুবক কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকের
শ্রমবাজারের সাথে থাকে দুর্বল যোগাযোগ এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে থাকে
তথ্যের অভাব।
গুরুত্বপূর্ণ
হচ্ছে লোঈ তার ‘Social Capital’ - এর ধারণাকে আরও বি¯তৃত করতে তেমন কোন কাজ করেননি। মূলত তার ধারণা গড়ে উঠেছে অর্থডক্স লেবার ইকোনোমিক্সের সমালোচনা
করবার মধ্যদিয়ে। লোঈ
তার লেখায় (লোঈ, ১৯৭৭)
মাত্র একবারই টার্মটি ব্যবহার করেন।
লোঈ-র
উপরিউক্ত বিশ্লেষণের অধিকতর পরিশোধিত বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া যায়Coleman-এর
কাজে। কোলম্যান তাদের কাজের কৃতজ্ঞতা
স্বীকারে লোঈর অবদানের কথা যেমন উল্লেখ করেছেন, তেমনি উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ Ben-Porath, সমাজতাত্ত্বিক Nan Lin এবং মার্ক গ্রানোডেটের কথা। তবে এটা খুবই আগ্রহ উদ্দীপক যে, কোলম্যান তার কাজে বর্দুর কথা উল্লেখ করেননি। কোলম্যান ‘Social Capital’- কে
এর ক্রিয়াশীলতার ভিত্তিতে একে নিুোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, “বিভিন্ন ধরনের অস্তিত্বশীল বিষয়-
যাদের মধ্যে দু’টি
সাধারণ উপাদান বিদ্যমান। সামাজিক পুঁজিগুলো সমাজ কাঠামোর কোন না কোন উপাদানকে ধারণ করে এবং
এ্যাক্টদের কিছু ক্রিয়াশীলতাকে সঞ্চালন করে। কাঠামোর মধ্যে সেই এ্যাক্টর হতে পারে ব্যক্তি কিংবা “কর্পোরেট
এ্যাক্টর”।
পোর্টেজ
কোলম্যানের এই সংজ্ঞায়নকে তুলনামূলক অস্পষ্ট সংজ্ঞায়ন হিসেবে দেখাতে চান। কোলম্যান ‘Social Capital’- ধারণাটির
আলোচনায় তিনটি উপাদানকে সবসময় মিশ্রভাবে বিদ্যমান হিসাবে দেখাতে চান। এগুলো হলো:
(ক)
‘Social Capital’- এর
স্বত্ত্বাধিকারীরা,
(খ)
‘Social Capital’- এর
উৎস সমূহ এবং
(গ)
উৎসগুলো নিজেরাই।
কোলম্যানের
হেন স্থাপন ‘Social Capital’- ব্যবহার এবং সুযোগে সংকট তৈরি
করে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সীমাবদ্ধতা স্বত্বেও কোলম্যানের
কাজ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
এই
তিনজন তাত্ত্বিকের কাজের পরবর্তী সময়ে ‘Social Capital’-এর উপর বেশকিছু তাত্ত্বিকের
লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছে। যেমন ১৯৯০-এ WE Baker বলছেন, ‘Social Capital’- হলো, “একটি উৎস, যেটিকে এ্যাক্টররা নির্দিষ্ট
সমাজ কাঠামো হতে বের করে এবং নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে”। আবার M Schiff - এর
মতে ‘Social Capital’- হলো, “সমাজ কাঠামোর একসেট উপাদান, যেগুলো মানুষের সম্পর্কে প্রভাব
ফেলে এবং এগুলোকে উৎপাদনে ও উপযোগিতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়”। আবার কোলম্যান এবং লোঈ যেখানে ‘Social Capital’- এর
ক্ষেত্রে নিবিড় সম্পর্ক জালকে (নেটওয়ার্ক) গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, সেখানে Burt বিপরীত ধর্মী এক অবস্থার কথা বলেন। তার মতে এটি হলো বন্ধনের
আপেক্ষিক অনুপস্থিতি। এটি সমতায়িত ‘কাঠামোগত
বলয়’ এবং এটি ব্যক্তির গতিশীলতাকে
সঞ্চালিত করে”।
Robert Putnam- এর ‘Social Capital’:
পুটনামের মতে ‘Social Capital’- বলতে
বোঝায়,
“সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়াদি-
যেমন: সম্পর্ক জাল, মূল্যবোধ, সামাজিক বিশ্বাস- যেগুলো
এ্যাক্টদের পারস্পরিক সুফল লাভের ক্ষেত্রে সমন্বয়ন ও সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে কাজ
করে”। বর্তমান সময়ে ‘Social Capital’-এর
মূল ধারা হিসেবে বিবেচ্য ধারাটি মূলত পুটনামই জনপ্রিয় করে তোলেন। ‘Social Capital’- প্রসঙ্গে
পুটনামের সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোচিত বইটির নাম ‘Bowling Alone: The Collapse and Revival of
American Community’ (১৯৯৫)। পুটনাম মনে করেন ‘Social Capital’- এর সাথে Civic Virtue - র
সম্পর্ক খুব কাছাকাছি। পুটনাম দুই ধরনের ‘Social Capital’-এর
মধ্যে ট্যাক্সোনোমিক বিভাজন তৈরি করেন। এর একটি Bonding এবং অপরটি Bridging। ‘Bonding Social Capital’ একই
ব্যাকগ্রাউন্ডের গভীর Social Network - এর আওতায় আনে। অন্যদিকে ‘Bridging Social Capital’ অসম
ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে বি¯তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
Fukuyama ‘Social Capital’ -এর সংজ্ঞা দেন। তার মতে ‘Social Capital’ হলো কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ ও নীতির ভাগাভাগি, যা সমাজের সদস্যদের মধ্যে একে
অন্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং একে অপরের প্রতি একটি বিশ্বাসের
জন্ম দেয়। এই
বিশ্বাস এই লুব্রিক্যান্টের ভূমিকা পালন করে, যা সংগঠনগুলোকে আরও কার্যকরভাবে চলতে সাহায্য করে।
‘Social Capital’- এর উৎস সমূহ:
পোর্টেজ
বলছেন অর্থনৈতিক পুঁজি থাকে মানুষের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে, হিউম্যান ক্যাপিটাল থাকে মানুষের
মাথায় এবং ‘Social Capital’- থাকে
মানুষগুলোর সম্পর্ক কাঠামোর মধ্যে। ‘Social Capital’- এ
মালিকানা থাকবার মধ্যদিয়ে একজন ব্যক্তি অবশ্যম্ভাবী ভাবে যুক্ত থাকবে অপর
ব্যক্তিদের সাথে। ‘‘Social Capital’- এর ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে
বিনিয়োগ বা অনুদান দিতে হতে পারে, ট্রাফিক
আইন মেনে চলতে হতে পারে। কারণ তারা এরকম কিছু আচরণ করবর বাধ্যবাধকত অনুভব করে। আত্মস্থকৃত মূল্যবোধই এরকম
আচরণকে সম্ভপর করে তোলে এবং অন্যান্যদের ক্ষেত্রে এই আচরণই হয়ে ওঠে সম্পদ, হয়ে ওঠে ‘Social Capital’।
‘Social Capital’- এর দ্বিতীয় উৎসটিকে খুঁজে পাওয়া
যায় কনজ্যুমেটরী ব্যবস্থায়। খুঁজে পাওয়া যায় মার্ক্সের বিশ্লেষণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রলেতারিয়েতদের
প্রেক্ষিতে। যেমন:
একই অবস্থায় থাকা শ্রমিকরা একে অন্যকে খুঁজে পেতে শেখে এবং একে অন্যের উদ্যোগে
সহযোগীতা করে। শ্রমিকদের
এই পারস্পরিক সৌহার্দ্র প্রদর্শন শৈশবে আত্মস্থকৃত কোন মূল্যবোধের প্রতিফলন নয়, বরং একই দশার অবশ্যম্ভাবী উৎপাদ।
‘Social Capital’- এর তৃতীয় ও চুড়ান্ত উৎস খুঁজে
পাওয়া যায় ডুর্খেইমের Social Integration তত্ত্বে। যেমন রেসিপ্রোসিটি বিনিময়ের
ক্ষেত্রে যারা চিফের কাছে তাদের ডোনেশন দেন, সেই ডোনেশন বা উপহার হয় ইন্সট্রুমেন্টাল। কিন্তু পুনর্বন্টনের মধ্যদিয়ে
পুনরায় পাবার প্রত্যাশা গ্রহণকারীর গ্রহণকারীর জ্ঞানের ভিত্তিতে হয়না। বরং তা উভয় এ্যাক্টরের (চীফ ও
গ্রহণকারী) একটি সাধারণ সমাজ কাঠামোতে সমন্বয়নের ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
‘Social Capital’এবং উন্নয়ন:
Ben Fine - তার ‘Social Capital’ - নামক
প্রবন্ধে বলছেন সামাজিক পুঁজি এবং উন্নয়নকে একসাথে আনা সম্ভব। কিন্তু উন্নয়ন পরিসরে ‘Social Capital’ -এর
প্রাধান্য মূলত প্রথম দিক থেকেই বিশ্ব ব্যাংকের এটিকে শক্তভাবে তুলে ধরার সাথে
নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, “বিশ্ব ব্যাংক কেন সামাজিক পুঁজিকে আঁকড় হিসেবে গ্রহণ করলো?” লক্ষ্য করবার মতো বিষয় হলো, বিভিন্ন দিক থেকেই সামাজিক পুঁজি
‘অংশগ্রহণ’, ‘ক্ষমতায়ন’- ইত্যাদি সহ অন্যান্য সমসাময়িক
ফাঁকা বুলিগুলোর কথা বলে। আর এগুলো ছিল ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ‘ড্রিম কনসেপ্ট’। মূলত
এই সময়ে বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ-এর কার্যক্রম গত বৈধতা নিয়ে সংকট তৈরি হয়। ঋণের সাথে সম্পৃক্ত তাদের
কার্যক্রমের নিও-লিবারেল পলিসি গুলো সমালোচনার মুখে পড়ে। ফলে তাদের কার্যক্রমের বৈধতাকে
পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য The Comprehensive
Development Framework (CDF) এবং Post
Washington-Consensus (PWC) - এর
নকশা করা হয়। CDF এবং PWC বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বেকার মতাদর্শের জায়গায় নতুন মতাদর্শ নিয়ে
আবির্ভূত হয়। যেখানেWashington-Consensus - এ নিও-লিবারেলিজমের মধ্যদিয়ে
কিভাবে উন্নয়ন সম্ভব সে সম্পর্কে সরল উক্তি দেওয়া হয়। এর বিপরীতে চডঈ একই মডেল সব
জায়গায় ফিট করেনা এবং সবকিছুকে মাইক্রো হবার প্রস্তাবনা দেয়।
সংক্ষেপে
বললে ‘সামাজিক পুঁজি’ ধারণা বিশ্ব ব্যাংকে বহিঃবিশ্ব
নিয়ে কাজ করবার একটি উপযুক্ত সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়। পাশাপাশি এটি আরও কিছু
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সুবিধাকে সম্ভপর করে তোলে। বিশ্ব ব্যাংকের দিকে তাকালে দেখা
যায়, সেখানে সংখ্য এবং বুদ্ধিবৃত্তি
উভয় দিকের বিবেচনায় অর্থনীতিবিদরা প্রতিনিধিত্বশীল। আর Washington-Consensus - এর ছায়ায় বিশ্ব ব্যাংক কিছু
সংখ্যক সমাজ বিজ্ঞানীর অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়। কিন্তু CDF এবং PWC বিশ্ব ব্যাংকে অ-অর্থনীতিবিদদের
গুরুত্বের সাথে নেবার একটি জায়গা করে দেয়। আর এক্ষেত্রে ‘Social Capital’ হয়ে ওঠে কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে
একটি সুবিবেচনা প্রসূত ধারণা।
সামাজিক পুঁজির প্রভাব: প্রেক্ষিত সমসাময়িক গবেষণা
বিভিন্ন
সাহিত্য পর্যলোচনা করলে সামাজিক পুঁজির তিনটি মৌলিক গুণ খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হলো:
(ক)
সামাজিক পুঁজি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উৎস,
(খ)
এটি পারিবারিক সহযোগিতার উৎস এবং
(গ)
এটি পরিবারের বাইরের নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যদিয়ে সুফল লাভের উৎস।
প্রথমটির
ক্ষেত্রে লেখক দেখতে পেয়েছেন, এটি
আইন কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক পুঁজি তৈরি হয় নিবিড়
সাম্প্রদায়িক যোগাযোগের মধ্যদিয়ে। ফলে এটি বাবা-মা, শিক্ষক
কিংবা পুলিশদের তাদের অধিনস্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। Zhou এবং Bankston Orleans –এর Vietnamese সম্প্রদায়ে কাজে করতে গিয়ে
আলোচ্য বিষয়টিকে নিন্মোক্তভাবে তুলে ধরেন:
পিতা-মাতা
এবং ছেলে-মেয়েরা একে অপরকে নজরের মধ্যে রাখে। যদি কোন ছেলে পরীক্ষায় ফেল করে
অথবা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে অথবা একটি ছেলে যদি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দেয় অথবা একটি
মেয়ে যদি বিয়ের পূর্বেই গর্ভধারণ করে, তবে সে কেবল নিজের কাছেই লজ্জিত হয়না, পুরো পরিবারের কাছে লজ্জিত হয়। একই বিশ্লেষণ আমরা দেখতে পাই
হাগানের বিশ্লেষণে। তিনি
পূর্ব জার্মানের যুবকদের মধ্যে কাজ করেছিলেন।
সামাজিক
পুঁজির দ্বিতীয় গুণের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে এটি পারিবারিক সহযোগিতার উৎস। পরিবারে মা-বাবার প্রাথমিক কাজ
থাকে সন্তান লালন-পালন করা। পরিবারে সন্তানটিকে বড় করে তোলার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি
লাভবান হয় শিশুটি। কেননা
শিশু তার প্রাথমিক পর্যায়ে যে সুযোগ পেল, সেটি শিশু ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হোয়া তার কাজের প্রেক্ষিতে
কোলম্যানের সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন, পরিবার শিশু এবং বয়স্ক উভয়ের জন্যই আবেগ ভাগাভাগির জায়গা, বিভিন্ন শিক্ষা সম্পর্কিত
বিষয়াবলী ভাগাভাগির জায়গা।
সামাজিক
পুঁজির তৃতীয় গুণটিকে আমরা পাই একটি পরিবারের সঙ্গে অপর একটি পরিবারের ভালো
সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। কিংবা এটিকে দেখা যেতে পারে একটি পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তির সাথে অপর পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যোগাযোগের মধ্যদিয়ে।
সামাজিক পুঁজির নেতিবাচক দিক:
সামাজিক
পুঁজির গবেষণায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিক পুঁজির ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রকৃত পক্ষে সামাজিক পুঁজির
কিছু নেতি বাচক দিকও আছে, যা
অনেক সময়ই আড়ালে থেকে যায়। এগুলোকে নিুোক্তভাবে তুলে ধরা যায়।
(ক)
এটি বহিরাগতকে কোন সুযোগ দেয়না- যার উদাহরণ হিসেবে ওয়ালডিঙ্গার দেখাচ্ছেন: ইতালীয়, আইরিশ ও পোলিশরা নিউইয়র্কে তাদের
যে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে সেখানে তাদের নিজেদের দেশের বাইরে কোন কর্মী নেওয়া
হয়না।
(খ)
সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের অতিরিক্ত দাবী বা পাওয়ার আকাক্সক্ষা- সুসম্পর্ক বা একই
গোত্রীয় হবার কারণে অনেকেই সহজেই একটি অনৈতিক দাবী করে বসে। গিয়ার্টজ বালি দ্বীপের
প্রেক্ষিতে দেখিয়েছেন, সেখানে
অল্প পুঁজির উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত সম্পৃক্ততার কারণে অবৈধ দোকান খুলে
বসেছে।
(গ)
সামাজিক পুঁজি ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা এনে দেয়-
কেননা ব্যক্তি তার পরিবার, গোষ্ঠী
এবং সমাজ কর্তৃক নজরদারীর মধ্যে থাকে। ফলে তাকে সকল পর্যায়ে জবাবদিহি করতে হয়। এই সংকটের কারণে অনেকেই সামাজিক
সম্পর্কে গভীরভাবে জড়াতে চায়না।
(ঘ)
সামাজিক পুঁজি মানুষের আদর্শ ও মূল্যবোধকে নিয়তই নিুমুখী করেছে। ব্যক্তির সাফল্য ব্যক্তির চাইতে
গোষ্ঠীর উপরই এখন বেশি নির্ভরশীল। এ বাস্তবতা কেবল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই নয়, পরিলক্ষিত হচ্ছে উন্নত বিশ্বের
দেশগুলোতেও। জুয়া, পতিতাবৃত্তি, তরুণদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে
সম্পৃক্ত হওয়া প্রভৃতি পেছনে কোলম্যান সামাজিক পুঁজির নেতিবাচকতার সম্পৃক্ততাকেই
খুঁজে পেয়েছেন।
সামাজিক
পুঁজি সম্পর্কিত উপরিউক্ত আলোচনা আমাদের সামনে এর সংজ্ঞারে বৈচিত্র্য, তাত্ত্বিক অবস্থানগত বৈচিত্র্য, উন্নয়ন পরিসরে এর আবির্ভাব এবং
অবস্থান, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো
তুলে ধরেছে। যার
ভিত্তিতে আমার বলতে পারি, “সামাজিক
পুঁজি সর্ব সামাজিক রোগের মহৌষধ” এমন
বক্তব্য যেমন সঠিক নয়, তেমনি
সামাজিক পুঁজিকে গুরুত্বহীন প্রপঞ্চ হিসেবে দেখবারও আমাদের কোন অবকাশ নেই। সামাজিক পুঁজি একটি বহুমুখী ও বিস্তৃত
ধারণ।
গ্রন্থ ও প্রবন্ধ সহায়িকা
1. Cleaver, Frances; 2005. The Inequality of Social Capital and
the Reproduction of Chronic Poverty. University
of Bradford , UK
.
2. Fine, Ben; 2002. Social Policy and Development, Social Capital
as Point of Departure. Prepared for the UNRISD project and Social Policy in
Development Context.
3. Portes, Alejandro; 1998. Social Capital: Its Origins and
Applications in Modern Sociology. Annual Review of Sociology, Vol.24, pp. 1-24
4. Quibria, M.G; 2003. The Puzzle of Social Capital: A Critical
Review. Asian Development Review, Vol:20, NO:2, 2003.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন